যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান (এমবিএস)- এর মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। রিয়াদে অনুষ্ঠিত বৈশ্বিক বিনিয়োগ সম্মেলনে ট্রাম্পের সরাসরি বক্তব্য, প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন এবং সৌদি নেতৃত্বের প্রতি প্রকাশ্য প্রশংসা শুধু হাস্যরসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না— তা ছিল একটি সুসংগঠিত কৌশলগত বার্তা।
‘রাতে আাপনি ঘুমান কিভাবে’— উষ্ণ কৌতুকের আড়ালে নেতৃত্বের মাপকাঠি
সম্মেলনে বিশ্বের শীর্ষ ব্যবসায়ী ও রাষ্ট্রপ্রধানদের উপস্থিতিতে ট্রাম্প বলেন, এমবিএস, আপনি রাতে ঘুমান কিভাবে? এত চাপের মধ্যেও কিভাবে নিজেকে সামলান? আপনি নিশ্চয়ই রাতভর এপাশ-ওপাশ করেন, ভাবেন— ‘আমি আরও কিভাবে ভালো করতে পারি?’
ট্রাম্পের এই মন্তব্যে সম্মেলনস্থলে হাসির রোল পড়ে যায়। তবে বিশ্লেষকদের মতে, এটি নিছক কৌতুক ছিল না; বরং এটি একজন নেতা কতটা আত্মচিন্তনশীল, পরিশ্রমী ও উচ্চাভিলাষী, তার এক ধরনের স্বীকৃতি।
‘আমি তাকে খুব বেশি পছন্দ করি’— সৌদি রূপান্তরের প্রতি ট্রাম্পের শ্রদ্ধা
ট্রাম্প আরও বলেন, অনেকে বলেছিল সৌদি আরব কখনোই আধুনিক বিশ্বে জায়গা করে নিতে পারবে না। কিন্তু গত আট বছরে এই দেশ সেই সব সমালোচকদের ভুল প্রমাণ করেছে। আমি মোহাম্মদ বিন সালমানকে সত্যিই পছন্দ করি—আসলে, অনেক বেশি।’
এই মন্তব্যের মাধ্যমে ট্রাম্প সৌদি আরবকে একটি উদীয়মান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে তুলে ধরেন এবং প্রিন্স এমবিএসকে তার দৃষ্টিতে এক দুর্দান্ত আধুনিক নেতা হিসেবে চিহ্নিত করেন।
কৌশলগত চমক: সিরিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার ও বিশাল বিনিয়োগ ঘোষণা
সম্মেলনে ট্রাম্প ঘোষণা দেন, তুরস্ক ও সৌদি আরবের অনুরোধে সিরিয়ার ওপর আরোপিত মার্কিন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হচ্ছে। সৌদি আরবের সঙ্গে ১৪২ বিলিয়ন ডলারের প্রতিরক্ষা চুক্তি এবং ৬০০ বিলিয়ন ডলারের একটি বৃহৎ বিনিয়োগ চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে, যার আওতায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, পরিকাঠামো, শক্তি ও পরিবেশ খাত উন্নয়নে সহযোগিতা করা হবে।
এই ঘোষণা শুধু দু’দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্কের গভীরতাই প্রকাশ করে না, বরং মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ভূরাজনৈতিক পুনরাবির্ভাবেরও ইঙ্গিত দেয়।
মানবাধিকার প্রসঙ্গ উপেক্ষিত: সমালোচনার ঝুঁকি
বিশ্লেষকরা বলছেন, ট্রাম্পের বক্তৃতায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়, বিশেষ করে সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যাকাণ্ডের উল্লেখ না থাকাটা ছিল একটি সচেতন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এমবিএস বরাবরই এই হত্যার সঙ্গে নিজেকে জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন এবং নারীর অধিকারসহ কিছু সামাজিক সংস্কার চালু করেছেন। কিন্তু এসব সংস্কার সমান্তরালভাবে কঠোর দমন-পীড়ন, বাকস্বাধীনতার হ্রাস এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের দমন করে যাচ্ছে— যা মানবাধিকার সংগঠনগুলোর কাছে গভীর উদ্বেগের বিষয়।
যুক্তরাষ্ট্র-সৌদি সম্পর্কের ভিত্তি: আদর্শ নয়, স্বার্থ
ট্রাম্পের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতি এখন বাস্তববাদ ও পারস্পরিক অর্থনৈতিক স্বার্থের ওপর ভিত্তি করে নির্মিত। ট্রাম্প খুঁজছেন মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের হারানো প্রভাব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে। আর এমবিএস চান প্রযুক্তি, প্রতিরক্ষা সহযোগিতা এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি।
এই পারস্পরিক বোঝাপড়া কেবল দুই রাষ্ট্রনায়কের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং দুটি বৃহৎ দেশের কৌশলগত অগ্রাধিকারকেই প্রতিফলিত করে।