১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর ভারতের ইতিহাসের এক কলঙ্কজনক দিন। উত্তরপ্রদেশের অযোধ্যায় ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদে হামলা চালিয়ে সেটি ধ্বংস করে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (ভিএইচপি), ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ও শিব সেনার সমর্থকেরা। ওই ঘটনার জেরে সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়ে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। এতে প্রাণ হারান দুই হাজারের বেশি মানুষ।
বাবরি মসজিদ ভাঙার সময় প্রথম আঘাতকারী ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ছিলেন শিব সেনার তৎকালীন সক্রিয় কর্মী বলবীর সিং। সময়ের ব্যবধানে তার জীবনে এসেছে নাটকীয় পরিবর্তন। এখন তিনি পুরোদস্তুর একজন মুসলমান। নাম বদলে হয়েছেন মোহাম্মদ আমির।
নির্বাসন থেকে আত্মপরিবর্তনের শুরু
বলবীর সিংয়ের জীবনে এই রূপান্তর শুরু হয় বাবরি মসজিদ ভাঙার পর। বাড়ি থেকে বিতাড়িত হন, স্ত্রীও থাকেননি পাশে। এক সময় ভবঘুরের মতো জীবন কাটাতে হয়েছিল তাকে। এরপর বন্ধু যোগেন্দ্র পালের ইসলাম গ্রহণ তাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। সোনেপতে মাওলানা কলিম সিদ্দিকির কাছে গিয়ে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন এবং হন মোহাম্মদ আমির।
উগ্র রাজনীতির পথে পা রাখা
ইতিহাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইংরেজিতে স্নাতকোত্তর করা বলবীর সিং মা-বাবা ও ভাইবোনদের সঙ্গে থাকতেন হরিয়ানার পানিপথের কাছে একটি ছোট গ্রামে। তবে পানিপথে এসে স্থানীয়ভাবে মুসলমানদের অবজ্ঞা করার প্রবণতা এবং নিজেদেরও ‘গ্রাম থেকে আসা’ বলে হেয় করার ঘটনা তার মনে ক্ষোভ ও না–পাওয়ার বোধ তৈরি করে।
এই সময়েই তার পরিচয় হয় রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) একটি শাখার কর্মীদের সঙ্গে। তাদের কাছ থেকে পাওয়া ‘সম্মান’ তাকে ধীরে ধীরে টেনে নেয় সংগঠনের দিকে। পরে যুক্ত হন শিব সেনার সঙ্গে। শিব সেনার রাজনীতির মধ্যেই বিয়ে করেন, রোহতকের মহর্ষি দয়ানন্দ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ ডিগ্রি নেন।
তখন প্রতিবেশীদের চোখে তিনি ছিলেন এক কট্টর হিন্দুত্ববাদী কর্মী। শিব সেনার নির্দেশেই বলবীর সিং বন্ধু যোগেন্দ্র পালসহ অযোধ্যায় যান বাবরি মসজিদ ভাঙতে। সেখানে তারা করসেবক হিসেবে অংশ নেন।
মসজিদ ভেঙে পানিপথে ফেরার পর তাদের দেওয়া হয় বীরোচিত সংবর্ধনা। বাবরি মসজিদের মাথায় শাবল চালানোর পর সঙ্গে করে আনা দুটি ইট শিব সেনার স্থানীয় কার্যালয়ে সাজিয়ে রাখা হয়।
ভাঙন, অনুশোচনা ও ধর্মান্তর
সংবর্ধনার পর বাড়ি ফিরেই বাবা দৌলতরামের কঠোর সিদ্ধান্তের মুখে পড়েন বলবীর। বাবা বলেন, ‘এই বাড়িতে হয় তুমি থাকবে, না হলে আমি।’ শেষ পর্যন্ত বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হন তিনি। স্ত্রীও তার সঙ্গে যাননি। ওই সময় ভবঘুরের মতো জীবন কাটাতে হয় তাকে। তার ভাষায়, তখন লম্বা দাড়িওয়ালা কাউকে দেখলেই ভয় পেতেন।
মোহাম্মদ আমিরের ভাষ্য, তিনি যে পরিবারে বড় হয়েছেন, সেখানে উগ্র হিন্দুত্ববাদ কখনোই ছিল না। তার বাবা গান্ধীর আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন এবং ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগের যন্ত্রণা গভীরভাবে অনুভব করেছিলেন। মুসলিম প্রতিবেশীদের তিনি আগলে রাখতেন। মূর্তিপূজায় বিশ্বাস করতেন না, মন্দিরেও যেতেন না।
কিছুদিন পর বাড়ি ফিরে জানতে পারেন, বাবা মারা গেছেন। এরপর পুরোনো বন্ধু যোগেন্দ্র পালের খোঁজ নিতে গিয়ে আরও ভেঙে পড়েন তিনি। জানতে পারেন, যোগেন্দ্রও ইসলাম গ্রহণ করেছেন। যোগেন্দ্র তাকে বলেছিলেন, বাবরি মসজিদ ভাঙার পাপবোধ থেকেই তার মানসিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, পরে তিনি মুসলমান হন।
এরপর দেরি করেননি বলবীর সিংও। হরিয়ানার সোনেপতে গিয়ে মাওলানা কলিম সিদ্দিকির কাছে গিয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। নতুন নাম নেন মোহাম্মদ আমির।
সূত্র: ২০১৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর মুম্বাই মিররে প্রকাশিত প্রতিবেদন।