এ পর্যন্ত যতবার যুদ্ধে জড়িয়েছে ভারত-পাকিস্তান

দক্ষিণ এশিয়ার দুই প্রতিবেশী এবং পারমাণবিক শক্তিধর দেশ ভারত ও পাকিস্তান। দীর্ঘদিন ধরে বৈরিতা, সংঘাত এবং কাশ্মীর ইস্যুকে কেন্দ্র করে উত্তেজনার মধ্যে রয়েছে। পাকিস্তান ভূখণ্ডে বুধবার (৭ মে) ভোরে ভারতের চালানো হামলা দুই দেশের পুরোনো বৈরিতা আবারও সামনে এনেছে। 

পাকিস্তানের দেয়া তথ্য মতে, এতে অন্তত ২৬ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছে, যা অঞ্চলটিকে নতুন করে উত্তপ্ত করে তুলেছে।

সাম্প্রতিক হামলা: যা ঘটেছিল
২২ এপ্রিল জম্মু-কাশ্মীরে পর্যটকদের ওপর সন্ত্রাসী হামলায় ২২ জন নিহত হয়, যার জন্য ভারত পাকিস্তানকে দায়ী করে। পাকিস্তান অবশ্য শুরু থেকে এ অভিযোগ অস্বীকার করে। এর পর থেকে সীমান্তে নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর দুই দেশের মধ্যে হামলা-পাল্টা হামলা চলে আসছিল, যা ৭ মে’র ভোরে ভারতীয় বিমান হামলায় চূড়ান্ত রূপ নেয়।

এই পরিস্থিতি শুধু সীমান্তে নয়, দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক স্থিতিশীলতাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করছে।

১৯৪৭: দেশ ভাগ ও প্রথম যুদ্ধ
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানে ভারত ও পাকিস্তান আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে জন্ম নেয়। দেশ ভাগের সময় কাশ্মীর রাজ্যের ভারত বা পাকিস্তানে যুক্ত হওয়া নিয়ে সৃষ্ট দ্বন্দ্ব প্রথম ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের জন্ম দেয়। ১৯৪৯ সালে জাতিসংঘের মাধ্যমে যুদ্ধবিরতি ও ‘লাইন অব কন্ট্রোল’ স্থাপন করা হয়, যা আজও দ্বন্দ্বের কেন্দ্রবিন্দু।

১৯৬৫: কাশ্মীর যুদ্ধ
কাশ্মীর নিয়ে দ্বিতীয় যুদ্ধ হয় ১৯৬৫ সালে। পাকিস্তান ভারতকে অভিযুক্ত করে ‘অবৈধ দখল’ এর জন্য। সেপ্টেম্বরের যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে যুদ্ধ থামে, কিন্তু সমস্যা থেকে যায়।

১৯৭১: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ
পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) স্বাধীনতার জন্য রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম শুরু করলে পাকিস্তান সামরিক অভিযান চালায়। ভারতের হস্তক্ষেপ এবং নয় মাসের যুদ্ধের পর ৩০ লাখের বেশি নিরীহ মানুষের প্রাণহানি ও শরণার্থী সংকটের মধ্য দিয়ে জন্ম নেয় স্বাধীন বাংলাদেশ।

১৯৮৯-৯০: কাশ্মীর যুদ্ধ
কাশ্মীরে ভারতবিরোধী যুদ্ধ শুরু হলে ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসীদের অর্থায়ন ও প্রশিক্ষণের অভিযোগ তোলে, যা পরবর্তী কয়েক দশক ধরে সংঘাতকে জিইয়ে রাখে।

১৯৯৯: কারগিল যুদ্ধ
পাকিস্তান কারগিল অঞ্চলে ভারতীয় সেনাঘাঁটি দখল করতে গেলে দুই দেশের মধ্যে তীব্র লড়াই শুরু হয়। আন্তর্জাতিক চাপ ও পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েনের আশঙ্কার মধ্যে পাকিস্তান পিছু হটে।

২০১৯: পুলওয়ামা হামলা ও প্রতিক্রিয়া
কাশ্মীরের পুলওয়ামায় আত্মঘাতী হামলায় ৪০ জন ভারতীয় জওয়ান নিহত হলে ভারত পাকিস্তানের অভ্যন্তরে বিমান হামলা চালায়। পাকিস্তান ভারতের যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করে এবং এক পাইলটকে আটক করে, পরে ফেরত দেয়।

দুই দেশের মধ্যে যে কারণে কমছে না উত্তেজনা
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে দ্বন্দ্বের মূল কেন্দ্র কাশ্মীর। উভয় দেশই অঞ্চলটিকে নিজেদের অংশ দাবি করে এবং এই প্রশ্নে উভয়ের জাতীয়তাবাদী রাজনীতি জড়িয়ে আছে। কাশ্মীরের রাজনৈতিক, ধর্মীয় এবং ভৌগোলিক জটিলতা দুই দেশের মধ্যে শান্তি স্থাপনকে ক্রমেই কঠিন করে তুলেছে।

অন্যদিকে, দুই দেশের মধ্যে শক্তির ভারসাম্য, পারমাণবিক অস্ত্রের উপস্থিতি এবং সীমান্তে নিয়মিত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সদস্যদের মোতায়েন, এই বিরোধকে কেবল সীমিত সামরিক সংঘাতে রূপান্তরিত করে, কিন্তু মূল সমস্যার সমাধান আনে না।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
বিশ্ব সম্প্রদায় এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতা নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন। জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং রাশিয়ার মতো শক্তিশালী দেশগুলো শান্তি স্থাপনে কূটনৈতিক উদ্যোগ নেওয়া শুরু করেছে।

কূটনৈতিক সমাধান, সংলাপ ও আস্থা গড়ে তোলা- এ তিনটি পথ ছাড়া এশিয়ার এই গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে স্থায়ী শান্তি নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। একদিকে পাকিস্তানকে সন্ত্রাসবাদ দূরীকরণের বাস্তব পদক্ষেপ নিতে হবে, অন্যদিকে ভারতকেও কাশ্মীরে মানবাধিকার ও রাজনৈতিক অধিকার নিয়ে ইতিবাচক পদক্ষেপ নিতে হবে।