পাবনার কৈটোলা গ্রামে আকাশকলি দাসের বাড়ি। উপজেলা সদর থেকে আট কিলোমিটার দূরে সাড়ে পাঁচ বিঘা আয়তনের বাড়িটিতে আকাশকলি দাস গড়ে তুলেছেন পাখিদের অভয়াশ্রম। জঙ্গলঘেরা বাড়িটির কাছে যেতেই পাখির কলতানে মন ভরে উঠবে যে কারো।
পাখিদের প্রতি তার অকৃত্রিম ভালোবাসা নতুন নয়। পাখির প্রতি তার এমন ভালোবাসা দেখে গ্রামের লোকেরা তাকে ‘পাখিবন্ধু’ বলে ডাকেন। ‘পাখিবন্ধু’ বলে পরিচিত ৮৮ বছরের চিরকুমার আকাশকলি দাস বিয়ে করেননি। ধারে কাছে স্বজন বলতে একমাত্র বোন ঝর্ণা দাস (৭০)। সেই বোনও বিয়ে করেননি। এসব পাখিই তাদের স্বজন বা পরিবারের সদস্য।
আকাশকলি দাস দিনরাত পাখিদের পাহারা দিয়ে রাখেন। প্রতিদিন তাদের জন্য পর্যাপ্ত খাবার দেন। তাকে দেখে গ্রামবাসীরাও পাখিদের ভালোবাসতে শিখেছেন। তাই কোনো পাখি শিকারি বাড়িটির ধারেকাছে এলে এখন আর আকাশকলি নন, গ্রামবাসীই তাদের প্রতিহত করেন। অবশ্য বিষয়টি জানাজানি হওয়ায় কোনো পাখি শিকারি এখন আর এই ধারে কাছে ঘেঁষে না।
পৈতৃক সূত্রে তিনি সাড়ে পাঁচ বিঘা আয়তনের যে বাড়িটি পেয়েছেন তার বেশির ভাগই জঙ্গলে ভরা। সেখানে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির বড় বড় সব গাছ। জঙ্গলঘেরা বাড়ির সেসব গাছগুলোতে শত শত পাখির আনাগোনা দেখে মৎস্য অধিদপ্তরের ওয়েটল্যান্ড বায়োডাইভারসিটি রিহ্যাবিলিটেশন প্রজেক্ট (ডব্লিউবিআরপি) ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে বাড়িটিকে ‘পাখির অভয়াশ্রম’ ঘোষণা করেছে। কাছে-দূরের বিভিন্ন এলাকা থেকে দর্শনার্থীরা পাখি দেখতে নিয়মিত ভিড় জমান সেখানে। বিশেষ করে অক্টোবরের শেষ থেকে শুরু করে গোটা শীত মৌসুমজুড়ে দর্শনার্থীদের ভিড় থাকে সবচেয়ে বেশি। কারণ এই সময়টাতে সেখানে দেশি পাখির সঙ্গে অতিথি পাখিরাও আশ্রয় নেয়।
আকাশকলি জানান, শুধু পাখি নয়, যে কোনো প্রাণীর প্রতি তার ভালোবাসা ছেলেবেলা থেকেই। রাস্তা থেকে বিপদে পড়া কুকুর, বিড়াল বাড়িতে নিয়ে এসে আশ্রয় দিতেন তিনি। তার বাড়ির গাছগুলোতে পাখিদের ভিড় লেগেই থাকত। বিষয়টি দেখে অভিভূত হন ‘পাখিবন্ধু’ আকাশকলি। ভাত রেঁধে গাছের নিচে বেশ কিছুটা অংশজুড়ে কলাগাছের পাতায় পাখিদের জন্য রাখতে শুরু করেন। পাখিরাও তার দেওয়া খাবার খেতে থাকে। এভাবে নিরাপদ আশ্রয় ও খাবার পেয়ে পাখিদের সংখ্যা সেখানে দিন দিন বাড়তে থাকে। আকাশকলি এখনো পাখিদের প্রতিদিন খাবারের ব্যবস্থা করে যাচ্ছেন। এছাড়াও পাখি শিকারিদের নিষ্ঠুর হাত থেকে পাখিদের রক্ষা করতে পাহারা দেওয়া শুরু করেন তিনি। এরপর তিনি পাখিদের জন্য খাওয়ার ব্যবস্থা শুরু করেন।
‘পাখিবন্ধু’ আকাশকলি আরও জানান, ‘পাখিদের না খাইয়ে তার খেতে ইচ্ছা করে না। পাখিরা তার সন্তানের মতো। এটা পাখিরা ভালোবাসা বোঝে বলেই বাড়িতে এসেই ওরা ভিড় করে।’
আকাশকলির বাড়িতে পাখিদের ব্যাপক ভিড়ের কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে উপজেলার গণ্ডি পেরিয়ে বিভিন্ন এলাকা থেকে দিন দিন বাড়তে থাকে দর্শনার্থীদের ভিড়। পাখির এমন নিরাপদ আবাসস্থলের বিষয়টি নিয়ে পরিবেশবাদী বেসরকারি সংগঠন (এনজিও) আইইউসিএনের সহযোগিতায় এগিয়ে আসে। পরে ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে বাড়িটিকে ‘পাখি অভয়াশ্রম’ ঘোষণা করে মৎস্য অধিদপ্তর। তবে অভয়াশ্রম ঘোষণা করা হলেও এ ব্যাপারে সরকারের পক্ষ সেখানে বিশেষ কোনো সহযোগিতা বা উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না।
আকাশকলি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত একজন শিক্ষক। রাখাল আর কাজের লোক দিয়ে খামার ও কৃষিজমি দেখাশোনা করেই দিন চলে তার। পাখিদের পরিচর্যায় দিনের বেশিরভাগ সময় কাটে তার। তবে বয়সের ভারে আগের মতো তেমন কিছুই আর করতে পারেন না।
মনজুর কাদের মহিলা কলেজের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘আমি সময় পেলেই পরিবার নিয়ে তার বাড়িতে পাখি দেখতে যাই। তিনি শুধু পাখিদের রক্ষা করছেন না, পরিবেশকেও বাঁচিয়ে রাখছেন। তার মতো আরো কিছু মানুষ থাকলে আমাদের পরিবেশ ক্ষতির হাত থেকে বাঁচত।’
বেড়া উপজেলা বন কর্মকর্তা ওমর ফারুক বলেন, ‘আমি তার অভয়াশ্রমে গিয়ে মুগ্ধ হয়েছি। কেউ যাতে পাখি শিকার করতে না পারে সে ব্যাপারে আমি সব সময় খেয়াল রাখছি।’