১২ মাসই নৌকায় যেতে হয় স্কুলে, সড়কের আশায় এলাকাবাসী

পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলার দেউলবাড়ী ইউনিয়ন যেন প্রকৃতির আঁচলে জড়ানো এক বিস্তৃত জলাভূমি। বছরের অধিকাংশ সময়ই এই অঞ্চল থাকে পানিতে টইটম্বুর। দিগন্তজোড়া বিল, ছড়িয়ে থাকা কচুরিপানা, মৃদু পানির ঢেউ আর ভোরের কুয়াশা মিলে এক অপার সুন্দর নিসর্গ উপহার দেয়।
 
কিন্তু এই সৌন্দর্যের আড়ালে লুকিয়ে আছে স্থানীয় মানুষের দীর্ঘ দিনের ভোগান্তি। বিশেষ করে স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসাগামী শিক্ষার্থীদের। কারণ দেউলবাড়ীর শিক্ষার্থীদের জন্য সারাবছর নৌকাই হলো একমাত্র ভরসা।
 
এই বিলাঞ্চলে স্থায়ী সড়ক না থাকায় প্রতিদিন নৌকা পাড়ি দিয়েই যেতে হয় স্কুল-কলেজে। বর্ষাকাল তো বটেই, শীত-গ্রীষ্মেও পানির উপদ্রব কমে না। কোথাও তীব্র পানির স্রোত, কোথাও হঠাৎ কচুরিপানার চাপে নৌকা আটকে যাওয়া- এসবই শিক্ষার্থীদের নিত্যসঙ্গী।
 
 
মাঝেমধ্যে নৌকা ডুবির ঘটনাও ঘটে, তাতে ভিজে নষ্ট হয়ে যায় বই-খাতা, ভিজে যায় ইউনিফর্ম। অনেক শিক্ষার্থী পরীক্ষার দিনও নৌকা বিলম্বের কারণে সময়মতো পৌঁছাতে পারে না, কেউ কেউ স্কুলে যেতে ভয়ও পায়।
 
শিক্ষার্থীরা বলছে, প্রতিদিন নৌকা নিয়ে বের হওয়া তাদের কাছে এক ধরনের মানসিক চাপ। ভোরবেলা ঘর থেকে নেমেই পানির ওপর ভাসমান থাকার অনুভূতিতে শুরু হয় দিনের পথচলা। ধুলা-মাটির সাধারণ একটি রাস্তার আশায় তারা তাকিয়ে আছে বহু বছর ধরে।
 
শিক্ষার্থী বায়েজিদ জানায়, প্রতিদিন নৌকায় ওঠার আগে থেকেই মনে ভয় কাজ করে। ভোরবেলা কুয়াশার মধ্যে বের হতে হয়, পানির ওপর দিয়ে এগোতে গিয়ে নৌকা দুললে মনে হয়—আজ হয়তো পৌঁছানো সম্ভব হবে না। সে মনে করে, একটি সড়ক হলে তাদের এই দুশ্চিন্তা আর কষ্ট অনেকটাই কমে যেত।
 
অভিভাবকদের উদ্বেগ আরও গভীর। তারা চান, সন্তানেরা নিরাপদে স্কুলে যাতায়াত করুক। নৌকা ডুবির ভয়, বই-খাতা নষ্ট হয়ে যাওয়ার ঝামেলা, হঠাৎ বৃষ্টি বা ঝড়ের মধ্যে নৌকায় আটকে পড়া এসবের কারণে পরিবারগুলো প্রতিদিন উদ্বেগে থাকে।
 
অভিভাবক ইকবাল তালুকদার বলেন, সন্তানেরা এমন ঝুঁকি নিয়ে প্রতিদিন স্কুলে যায়, এটা ভেবে তারা সারাদিন চিন্তায় থাকেন। নৌকা ডুবির ভয়, বই নষ্ট হওয়ার ঝামেলা, আকস্মিক বৃষ্টি কিংবা ঝড় সব মিলিয়ে দেউলবাড়ীর পরিবারগুলোকে প্রতিদিন উদ্বেগে থাকতে হয়। তিনি জানান, এলাকার ভবিষ্যৎ শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার স্বার্থে একটি সড়ক জরুরি হয়ে পড়েছে।
 
নাজিরপুরে ১২ মাস নৌকায় যেতে হয় স্কুলে
 
দেউলবাড়ী ইউনিয়নের বাসিন্দারা আশা করছেন, যথাযথ কর্তৃপক্ষ দ্রুত বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করবে এবং এই দীর্ঘ দিনের দুর্ভোগ দূর করতে সড়ক নির্মাণে উদ্যোগ নেবে। কারণ একটি রাস্তা বদলে দিতে পারে পুরো ইউনিয়নের ভবিষ্যৎ, আর বাঁচাতে পারে নানা প্রতিকূলতার মধ্যে শিক্ষার্থীদের প্রতিদিনের ঝুঁকিপূর্ণ যাতায়াত।
 
সোনাপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. ছরোয়ার হোসেন বলেন, দেউলবাড়ী ইউনিয়নের শিক্ষার্থীদের নৌকানির্ভর যাতায়াত শিক্ষার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। অনেকেই প্রতিকূলতার কারণে দেরিতে আসে, কেউ কেউ নিয়মিত স্কুলে আসতেও পারে না। নিরাপদ যাতায়াত নিশ্চিত না হলে শিক্ষার মান উন্নয়নের কথাও ভাবা যায় না। তার বক্তব্য এই অঞ্চলে স্থায়ী উঁচু সড়ক নির্মাণ সময়ের দাবি।
 
দেউলবাড়ীর মানুষ মনে করেন, এ অঞ্চলে একটি স্থায়ী উঁচু সড়ক হলে বদলে যাবে পুরো এলাকার অবস্থা। শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি কমবে, জরুরি চিকিৎসাসেবা পৌঁছাতে সহজ হবে, কৃষিপণ্য পরিবহনেও আসবে নতুন সম্ভাবনা। বিলাঞ্চলের এই শিশু-কিশোরদের শিক্ষার আলো ধরে রাখতে একটি রাস্তা এখন সময়ের দাবি।