দক্ষিণাঞ্চলে মাঠ ভরা ধানেও কৃষকের ঘরে চাপা কষ্ট

দক্ষিণাঞ্চলে হেমন্তের রোদেলা আবহে মাঠজুড়ে শীতের আগমনী বার্তা। ভোরে হালকা কুয়াশা আর দিনের হালকা রোদ ধান কাটার জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করেছে। জেলার সব উপজেলায় আমন ধান পাকতে শুরু করেছে। উপজেলার গ্রামাঞ্চলে ধান কাটা শুরু হয়েছে, কোথাও পুরোদমে চলছে মাড়াই-শুকানোর কাজ। এই মৌসুমে ধানের সামগ্রিক ফলন ভালো হলেও স্থানীয় বাজারে ন্যায্য দাম না পাওয়ায় কৃষকদের মুখে হাসির বদলে হতাশার ছাপ স্পষ্ট।
 
জমি চাষ, চারা উৎপাদন বা ক্রয়, রোপণ শ্রমিক, সার-ওষুধ, পানি ব্যবস্থাপনা, আগাছা দমন, রোগ-পোকা নিয়ন্ত্রণ, কাটতি, মাড়াই ও পরিবহন খরচ প্রতিটি ধাপে খরচ বেড়েই চলেছে। কিন্তু মৌসুমের শুরুতেই বাজারে সক্রিয় হয়ে ওঠা এক শ্রেণির দালাল ও পাইকারি সিন্ডিকেট কৃষকদের ন্যায্য দাম পাওয়া আটকে দেয়। তাদের হাত ঘুরে স্থানীয় উৎপাদিত ধান সরকারি গুদাম ও বেসরকারি মিলে যায়, আর প্রান্তিক কৃষক লাভের বদলে লোকসানের ভয় নিয়ে মৌসুম কাটান।
 
 
পটুয়াখালী সদর উপজেলার কমলাপুর ইউনিয়নের চাষি মিলন মাঝি বলেন, প্রতি একরে ৩৭–৪০ হাজার টাকা ব্যয়ে ধান চাষ করেছেন তারা। ফলন হয়েছে ৪০-৪৬ মণ। স্থানীয় বাজারে প্রতি মণ ধান বিক্রি হচ্ছে ৯০০-১০০০ টাকায়। ব্যয় বাদ দিলে প্রতি একরে লাভ থাকে মাত্র ৫০০০–৭০০০ টাকা। যা দিয়ে পরিবারের সারা বছরের খরচ চালানো অসম্ভব। কৃষকদের আশঙ্কা, মৌসুমের ভাড়া (পিক সিজন) এলে দাম আরও কমে যেতে পারে।
 
কলাপাড়া উপজেলার মিঠাগঞ্জ ইউনিয়নের কৃষক বেলাল হোসেন জানান, এ বছর ধানের ফলন ভালো হলেও দাম খুবই কম। উৎপাদন খরচ বাড়ার কারণে লাভের পরিমাণ কমে এসেছে।
 
বেলাল হোসেন আরও জানান, সরকারি সার ডিলারদের একটি সিন্ডিকেট নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি দামে সার বিক্রি করায় উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে। পাশাপাশি নিম্নমানের বীজ বিক্রির কারণে অনেক কৃষকের মাঠে ফলন কম হয়েছে। ফলে অনেক কৃষক এখন ক্ষতির মুখোমুখি। এলাকার পাইকারের মাধ্যমে প্রতি মণ ধান বিক্রি করছি ১০০০-১১০০ টাকায়। কিন্তু তাদের দিতে হচ্ছে ৪০ কেজির পরিবর্তে ৪৬ কেজি।  
 
পটুয়াখালীর  কলাপাড়া উপজেলার পাখিমারা বাজারে গিয়ে দেখা যায়, কৃষকরা প্রতি মণ ধান বিক্রি করছেন ৯০০–১০০০ টাকায়। স্থানীয় শ্রমিক দিয়ে দালাল ও পাইকাররা এই ধান সংগ্রহ করে জেলার বাইরে বেসরকারি মিলে পাঠায়। তাদের কেনা-বেঁচার দাম সম্পর্কে জানতে চাইলে কেউ মুখ খুলতে চাননি।
 
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পাইকার জানান, জেলার বিভিন্ন হাটে তাদের ছোট-বড় ক্রয়কারী দল রয়েছে। সপ্তাহজুড়ে এসব দল কৃষকদের কাছ থেকে ধান সংগ্রহ করে ট্রাকে করে মিলগুলোতে পাঠায়। পাইকারদের মধ্যে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ থাকায় বাজার নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতেই থাকে।
 
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসেবে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে পটুয়াখালীতে আমন ধানের আবাদ হয়েছে ১ লাখ ৯০ হাজার ১১৫ হেক্টর জমিতে। বছরে ধান উৎপাদন হয়েছে ৬ লাখ ৯২ হাজার ৬৩০ মেট্রিক টন— লক্ষ্যমাত্রার প্রায় সমান। চাল উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ লাখ ৫৭ হাজার ২৭১ মেট্রিক টন, উৎপাদন হয়েছে ৪ লাখ ৬১ হাজার ৭৫৩ টন।
 
২০২৫-২৬ অর্থবছরে আবাদ করা হয়েছে ১ লাখ ৮৯ হাজার ৮৩৮ হেক্টর জমিতে। ধানের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৬ লাখ ৯৫ হাজার ৮৭৬ টন এবং চালের লক্ষ্যমাত্রা ৪ লাখ ৬৩ হাজার ৯১৭ টন। মাঠ থেকে কাটতি শেষ হলে চূড়ান্ত উৎপাদন জানা যাবে।
 
 
কলাপাড়ার মনসাতলী বাজারের ধান ব্যবসায়ী রহিম মিয়া বলেন, আমরা ধান কেনা শুরু করেছি। কিন্তু গত বছরের চেয়ে এ বছর ধানের বাজার কম। অল্প অল্প ধান বাজারে ওঠা শুরু করেছে। মোকামে ধানের দাম কম থাকায় আমরা কীভাবে বেশি দেব। আমরা ধান কিনে ঢাকা, আশুগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ পাইকারদের কাছে আমরা বিক্রি করি। তারা ওদিকে নিয়ে যায়। কৃষকদের ৪৬ কেজি মণে দাম দিচ্ছি সাড়ে ১১৫০ থেকে ১২০০ টাকা।  
 
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ডা. মোহাম্মদ আমানুল বলেন, সরকার পটুয়াখালীতে এবারও ৫০ হাজার মেট্রিক টন ধান ৩৮ টাকা কেজি দরে মূল্য নির্ধারণ করে খাদ্য অধিদপ্তরকে মজুদ করার নির্দেশ দিয়েছে। বাইরের লোক কম দামে ধান কিনে বেশি দামে বিক্রি করার চেষ্টা করবে। এ ব্যাপারে সবার সচেতন থাকতে হবে। সবাইকে অনুরোধ করছি কৃষকদের খাদ্য অধিদপ্তরে পাঠান কৃষকের উপকার হবে। বেশি দামে বিক্রি করতে পারবে। বাজার মনিটরিংয়ের ব্যাপারে প্রশাসন ব্যবস্থা নেবে। 
 
ফসল ভালো হলেও ন্যায্য দাম না পাওয়ায় কৃষকদের অভিযোগ, বছরে ৭-১০ একর জমি চাষ করেও সংসার চালানোর নিশ্চয়তা নেই। উৎপাদন বৃদ্ধির সব পরিশ্রম বাজারে এসে ভেঙে পড়ে। সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা না নিলে এবং কৃষকদের উদ্দেশে সরকারিভাবে সরাসরি ধান সংগ্রহ না বাড়ালে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে বলে মনে করছেন চাষিরা।
 
একদিকে মাঠ ভরা ধান, অন্যদিকে কৃষকের ঘরে চাপা কষ্ট। এমন বাস্তবতায় পটুয়াখালীর কৃষকদের প্রশ্ন, ফসল ভালো হলে আমরা লাভ পাবো— এই স্বপ্ন কি তবে অপূর্ণই থেকে যাবে?