এনজিও চাকরি ছেড়ে সফল উদ্যোক্তা প্রুনু মং, বছরে আয় ১৫ লাখ টাকা 

প্রুনু মং মারমা ছিলেন এনজিও কর্মী (ইউএনডিপি)। একপর্যায়ে জীবনকে নতুনভাবে দেখার ভাবনা থেকে ৩ বছর আগে তিনি কৃষি কাজে নেমে পড়েন। চাকরি ছেড়ে গড়ে তোলেন পেয়ারা, বরই (ভারত ও বল সুন্দরী) মাল্টা ও কমলা বাগান। দুই বছর পর শুরু করেন বিদেশি ফল ড্রাগনের বিশাল এক বাগান।

সেই বাগান থেকে তার আয় এখন মাসে আনুমানিক ৪-৫ লাখ টাকা, আর বছরে আয় করেন প্রায় ১৫ লাখ টাকা। ৪ বছর পর তিনি সফলতার মুখ দেখেছেন বলে জানান সফল এই উদ্যোক্তা।

প্রুনু মং মারমার গ্রামের বাড়ি বান্দরবান সদর উপজেলার কুহালং ইউনিয়নে কুহালং হেডম্যান পাড়া গ্রামে। মধ্যবিত্ত কৃষক পরিবারে জন্ম তার। তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনিই সবার ছোট। উচ্চশিক্ষা অর্জনের পর বিভিন্ন এনজিও ও কনষ্ট্রাকশন চাকরি করেও কোনোখানে মন টেকেনি তার। পরে চাকরি ছেড়ে কৃষিকে নিজের সাধনার ক্ষেত্র হিসেবে বেছে নেন। বর্তমানে তিনি একজন সফল কৃষি উদ্যোক্তা।

নিজ গ্রামের পাশের জমিতে আড়াই একরের জায়গায় শুরু করেছিলেন বড়ই ও পেয়ারা বাগান। সেগুলো ছাড়াও ড্রাগন, কমলা ও মাল্টা চাষ করেন প্রুনু মং মারমা। বর্তমানে তার ৫ একর মিশ্র ফলের বাগানে নিয়মিত ১০-১৫ জন মানুষ কাজ করেন।

এই উদ্যোক্তা পড়ালেখা শেষ করে শুরুতেই ইউএনডিপি নামে এক এনজিওতে চাকরি শুরু করেন। চাকরির পাশাপাশি একজন সফল উদ্যেক্তা হওয়ার স্বপ্ন বুনেন। প্রতিদিন ইউটিউবের ভিডিও দেখে সফল উদ্যেক্তার হওয়ার গল্প অনুসরণ করতে থাকে। কোন পদ্ধতিতে বিভিন্ন ফল চাষ করা হয় সেগুলো অভিজ্ঞতা নিতে পাড়ি দিয়েছিলেন মুন্সিগঞ্জ, ঝিনাইদ ও চুয়াদাঙ্গাসহ বেশ কয়েকটি জেলায়। সেখানকার সফল উদ্যেক্তার কৃষকের জমিতে চাষাবাদ বিষয়ে অভিজ্ঞতা নেন। 

পরবর্তীতে চাকরি ছেড়ে প্রথমে ২০২২ সালের দিকে নিজের আড়াই একর জমিতে শুরু করেন বড়ই (বল সুন্দরী), মাল্টা, কমলা ও পেয়ারা ফলের বাগান। ২০২৪ সালে এসে আরো আড়াই একর জমিতে শুরু করেন বিদেশী ড্রাগন ফলের চাষ। বর্তমানে তার ৫ একর মিশ্র ফলের বাগান থেকে বছরের আয় হয় প্রায় ১৫ লাখ টাকা।

বান্দরবান শহর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে কুহালং ইউনিয়নের ভাঙ্গামুড়া সড়কের পাশে দেখা মিলছে প্রুনু মং মারমা ড্রাগন ফলসহ ৫ একরের মিশ্র ফলের বাগান। বর্তমানে তার এই ফলের বাগানে ৭৫০০টি ড্রাগন ফলের গাছ, ৪৫০টি বড়ই গাছ (ভারত ও বল সুন্দরী), ৭০০টি পেয়ারা, কমলা ও পেয়ারা মিলে ২০০টি গাছ রয়েছে। 

গত বছরে ড্রাগন ফল বিক্রি করে আয় করেছিলেন ৩ লাখ টাকা, একইভাবে কমলা, মাল্টা ও বরই বিক্রি করে আয় করেছেন ৪ লাখ টাকা। চলতি বছরে ১ টন ড্রাগন ফল ছিড়েছেন। সেটি বাজারে বিক্রি পর এবারে ড্রাগন ফল থেকে আয়ের টার্গেট ৬ লক্ষ টাকা, আর অনান্য মিশ্র ফল থেকে ৮-৯ লাখ টাকা আয় হবে বলে আশাবাদী তিনি।

ভাঙ্গামুড়া বাসিন্দা হ্লামংপ্রু মারমা বলেন, এই এলাকায় অধিকাংশ মানুষ চাষাবাদ করে জীবন নির্বাহ করছে। শসা, সিম ও বেগুন এগুলো ছাড়া ফলের দিকে কম আগ্রহী হয়েছেন। এখন প্রুনু মং চাকরি ছেড়ে উদ্যোক্তা হয়ে মাসে যে আয় করছেন, তা দেখে তরুণরাও তাকে অনুসরণ করছে। চাকরির পেছনে না ছুটে একজন সফল উদ্যোক্তা হওয়া খুবই প্রশংসনীয়।

৫ন একর বাগানের দেখাশোনা আর প্রতিনিয়ত পরিচর্যা করেন উশৈহ্লা মারমা। তিনি বলেন, আমি মিশ্র ফলের বাগান দেখাশোনা করছি তিন বছর। বাগান পরিষ্কার থেকে শুরু করে প্রতিটি ফল গাছের পরিচর্যা করছি। প্রতিদিন আমার পারিশ্রমিক ৮শত টাকা করে পাচ্ছি। বাগানের ফল ফর্মালিন মুক্ত, স্বাদেও মিষ্টি। শুধু ড্রাগন নয়, পেয়ারা, বল সুন্দরী, মাল্টা, কমলাও একই। চাহিদা থাকায় প্রতিদিন বাজারে বিক্রি করতে নিয়ে যাচ্ছি।

সম্প্রতি ভাঙ্গামুড়া এলাকায় গড়ে তোলা মিশ্র ফলের বাগানে কথা হয় প্রুনু মং মারমার সঙ্গে। ড্রাগন, পেয়ারা, বল সুন্দরী (বড়ই) ও কমলা ও মাল্টার মিশ্র ফলের বাগানটি ঘুরিয়ে দেখানোর সময় তিনি বলেন, পড়ালেখা শেষ করে বিভিন্ন এনজিও এবং কন্ট্রাকশনে চাকরি করেছেন দীর্ঘদিন। কিন্তু কোনোখানে মনের প্রশান্তি পাইনি। চাকরি ছেড়ে ২০২২ সালে এসে উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখি। প্রথমে ইউটিউব দেখে শুরু করেছিলাম বড়ই আর পেয়ারা ফলের চাষ। সেখান থেকে লাখ খানেক টাকা আয় হতে শুরু করে। 

এরপর শুরু করি ড্রাগন ফলের বাগান। এক বছরের মাথায় ড্রাগন থেকেও ৩ লাখ টাকা আয় করি। এখন আমার ৫ একর জমিতে ড্রাগন, বড়ই (বল সুন্দরী), মাল্টা, কমলা ও পেয়ারা ফলের বাগান আছে। শুরুতেই কিছুটা আর্থিক সমস্যা হলেও মৌসুমে ফল থেকে কয়েক লক্ষ টাকা পাচ্ছি। বর্তমানে আমার বছরের আয় প্রায় ১৫ লক্ষ টাকা।

সফল উদ্যোক্তা প্রুনু মং মারমা তরুণদের উদ্দ্যেশে বলেন, চাকরির পেছনে না ছুঁটে অল্প পুঁজির মাধ্যমে শুরু করলেও একজন সফল উদ্যেক্তা হওয়া যায়। বর্তমান সরকার কৃষি খাতের দিকে নজর দিচ্ছে, পাশাপাশি কৃষি বিভাগ থেকে প্রণোদনা দিচ্ছে। তাই বেকার তরুণ যারা রয়েছে, অল্প পুঁজিতে কৃষি বা যেকোন কিছু উদ্যোগ নিলে সেটি সফল হওয়া যায়। এতে দেশের বেকারত্ব দূর হবে বলে মনে করেন এই উদ্যেক্তা।

বান্দরবান কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক এস এম শাহনেওয়াজ বলেন, চাকরি ছেড়ে প্রুনু মং মারমা উদ্যোক্তা হয়ে সফলতা পেয়েছে বলে খবর পেয়ে তার বাগান পরিদর্শন করা হয়েছে। নিজ জমিতে ৫ একরজুড়ে ড্রাগন, মাল্টা, বড়ই ও পেয়ারা চাষ করেছেন। সেখান থেকে মাসে কয়েক লাখ টাকা আয় করছেন এই তরুণ উদ্যোক্তা। আর কৃষি বিভাগ থেকে প্রয়োজনীয় যা দরকার সবকিছু দিক নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। 

তিনি বলেন, তার সফলতার জন্য যদি আমাদের এখানে আবেদন করে তাহলে এই বছর সফল উদ্যোক্তা হিসেবে তাকে পুরষ্কার তুলে দেওয়া হবে। আর যারা বাণিজ্যিকভাবে কৃষি কাজ করতে চায়, আমরা তাদের উদ্বুদ্ধ করি। তরুণ ও বেকাররা কৃষিকাজে আগ্রহী হলে প্রান্তিক পর্যায়ে অর্থনীতি আরও সমৃদ্ধ হবে বলে আশা এই কৃষি কর্মকর্তার।