টানা এক বছরের বেশি সময় ধরে ঐতিহ্যবাহী চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের অচলাবস্থা বিরাজমান। ৫ আগস্টের পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি চরম অবনতির পরিস্থিতিতে কিছু বহিরাগত সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের সহযোগিতায় ভাংচুর ও লুটপাটের মাধ্যমে এ ক্লাব দখলে নেওয়া হয়।
চট্টগ্রামের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকারি প্রশাসন এ সময়ে রহস্যজনকভাবে নীরবতা পালন করেছে। দখলে নেওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা থাকলেও তা হয়নি।
বর্তমানে প্রশাসনের নাকের ডগায় চলছে সপ্তাহে ৪ দিনের জুয়ার আসর। লুট হয়ে যাচ্ছে ক্লাবের নিয়মিত আয়ের বড় একটি অংশ। গোপনে চলছে ক্লাবের বিভিন্ন ফ্লোর ভাড়া দেওয়ার নামে গোপন চুক্তির মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অপতৎপরতা।
তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম গতকাল ঢাকায় আন্তর্জাতিক তথ্য অধিকার দিবসে আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্য দিতে গিয়ে তিনি চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের পরিস্থিতি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এ সত্য প্রকাশ করায় চট্টগ্রামের সাংবাদিকদের ৮ সংগঠনের নেতারা তথ্য উপদেষ্টাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন।
তারা তথ্য উপদেষ্টাকে আহ্বান জানিয়েছেন হাল ছেড়ে না দিয়ে এ ক্লাবকে লুটেরা ও দখলদার গোষ্ঠীর হাত থেকে উদ্ধার করে এটিকে সচল করে অনতিবিলম্বে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য।
এর আগে তথ্য উপদেষ্টা বলেছেন, ‘প্রেসক্লাব দখল হয়ে আছে। চিটাগং প্রেসক্লাবের ইস্যু গত একবছরে আমি সল্ভ করতে পারিনি। বিকজ অব দ্য পলিটিক্যাল পার্টিজ ইনভলবমেন্ট ইজ দেয়ার। ওখানে জুয়া চলে। আরও কী কী চলে! আমি এগুলো ডিসিকে বলে বন্ধ করতে পেরেছি কিছুটা। কিন্তু প্রেসক্লাব ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর কারণে গত একবছরে একটা নির্বাচন হয়নি চিটাগং প্রেসক্লাবের।’
তিনি সাংবাদিকতা ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আরও নানা মূল্যবান কথা বলায় সাংবাদিক নেতারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন।
সাংবাদিকদের ৮ সংগঠনের নেতারা বিবৃতিতে বলেছেন, বিলম্ব হলেও তথ্য উপদেষ্টা চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের বাস্তব পরিস্থিতি অনুধাবন করতে পেরেছেন। এজন্য তাকে অভিনন্দন। তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছেন, এ ক্লাবের দখলদারদের লুটপাট ও অপসাংবাদিকতার বিষয়টি।গতকাল তথ্য উপদেষ্টার মুখে এ সত্য প্রকাশিত হওয়ার পর চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের নির্বাহী কমিটিসহ সর্বস্তরের সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে অভিনন্দন জানিয়ে ৮ সাংবাদিক সংগঠনের নেতারা বলেছেন, ৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের পর চিহ্নিত গুটিকয়েক সাংবাদিক সশস্ত্র সন্ত্রাসী নিয়ে ৬৩ বছরের এ ক্লাব দখল করে নেন। সন্ত্রাসীরা ওই সময় ব্যাপক ভাংচুর চালায়। লুটে নেয় কিছু নগদ অর্থ। কয়েকমাস অচলাবস্থা চলার প্রেক্ষাপটে চট্টগ্রামের তৎকালীন জেলা প্রশাসক ক্লাবের নির্বাচিত ব্যবস্থাপনা কমিটি অবৈধভাবে ভেঙ্গে দিয়ে নিজে আহ্বায়ক হয়ে ৪ সদস্যের একটি অন্তর্বর্তী কমিটি গঠন করেন।
এ ব্যাপারে চট্টগ্রামের সাংবাদিক সমাজ দফায় দফায় এহেন অপকর্মের প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়েছেন এবং সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে প্রশাসন রহস্যময় কারণে এগিয়ে আসেনি। ফলে ডিসিকে ব্যানারে রেখে অন্তর্বর্তী কমিটি অপর ৩ সদস্য এ ক্লাবকে ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে। বিলম্বে দখলদারদের চালবাজিসহ নানা বিষয় টের পেয়ে ডিসি এ কমিটি থেকে সরে গেছেন। কিন্তু খণ্ডিত কথিত কমিটি নানা অপকর্মে জাল বিস্তৃত করে রেখেছে। গঠনতন্ত্রের বিধিবিধান না মেনে তারা এ ক্লাবের ৯৬ স্থায়ী সদস্যের সদস্যপদ বাতিল/স্থগিত করেছে। পাশাপাশি মনগড়াভাবে অসাংবাদিকসহ অনেককে ক্লাবের সদস্যপদ দিয়েছে, যা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক ও ক্লাবের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্যের জন্য হুমকি স্বরূপ।
তারা আরো বলেছেন, প্রেসক্লাব বর্তমানে চাঁদাবাজদের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। দখলদারদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় নতুন সদস্যপদ লাভের তকমা দিয়ে রীতিমত কথিত মোবাইল কোর্টের ব্যানারে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অভিযানও চালিয়েছে। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অনেককে হুমকি-ধমকি দিয়ে চাঁদা আদায়ের পথ প্রশস্ত করে রেখেছে। এসব ঘটনায় কথিত সাংবাদিক নামধারীদের কেউ কেউ গ্রেপ্তারও হয়েছে। দখলদাররা ক্লাবের প্যাড ব্যবহার করে অনৈতিক পন্থায় ডিও লেটার পর্যন্ত প্রদান করছে, যা সৎ সাংবাদিকতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করে রেখেছে।
চট্টগ্রামে কর্মরত সাংবাদিকরা দখলদারদের প্রতি অনাস্থা প্রকাশের জের স্বরূপ ক্লাবে আসা-যাওয়ার বন্ধ রেখেছে। প্রশাসনের জ্ঞাতসারে দখলদাররা এ ক্লাবের অর্থসম্পদ লুটের পাশাপাশি ক্লাবের বিভিন্ন ফ্লোর অবৈধভাবে গোপন চুক্তি ও ভাড়া বাণিজ্য শুরু করেছে। এসব ঘটনা নিয়ে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের নির্বাচিত ব্যবস্থাপনা কমিটি সংশ্লিষ্ট সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ইতোমধ্যে সংবাদপত্রে বিবৃতি দিয়েছে।
কিন্তু দখলদাররা তাদের অপকর্ম অব্যাহত রেখেছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতেও এ ক্লাবের সাধারণ সদস্যরা শান্তিপূর্ণ অবস্থান নিয়ে আছেন। তবে আগামীতে যেকোনো ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত সংঘাত এড়াতে অনতিবিলম্বে দখলদারদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করে ২৮৩ স্থায়ী সদস্যদের নিয়ে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট সকল স্তরের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন সাংবাদিকরা।
বিবৃতি প্রদানকারী ৮ সংগঠনের নেতারা হলেন- বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) সহসভাপতি শহীদ উল আলম, যুগ্ম মহাসচিব মহসিন কাজী, চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের নির্বাচিত সভাপতি সালাহউদ্দিন মো. রেজা, সাধারণ সম্পাদক দেবদুলাল ভৌমিক, চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি রিয়াজ হায়দার চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক সবুর শুভ, চট্টগ্রাম সাংবাদিক কো-অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটির সভাপতি খোরশেদ আলম ও সম্পাদক যীশু রায় চৌধুরী, চট্টগ্রাম টিভি জার্নালিস্ট এসোসিয়েশনের সভাপতি নাসিরুদ্দিন, ফটো জার্নালিস্ট এসোসিয়েশনের সভাপতি রাশেদ মাহমুদ ও সাধারণ সম্পাদক রাজেশ চক্রবর্তী, বাংলাদেশ ফটো জার্নালিস্ট এসোসিয়েশন চট্টগ্রামের সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক মিয়া আল।