বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। ওইদিনই দেশের বেশিরভাগ থানা ও পুলিশ ক্যাম্পগুলোর মতো চট্টগ্রামের অধিকাংশ থানায়ও হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ করা হয়। লুট হয়ে যায় বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ। যার একটি বড় অংশ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এখনও উদ্ধার করতে পারেনি।
লুট হওয়া ওইসব অস্ত্র দিয়ে এরই মধ্যে দুর্বৃত্তরা ছিনতা-ডাকাতিসহ নানা অপরাধ কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক সহিংসতা, হত্যা, আধিপত্য বিস্তার, বালু ও মাটি ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ, চাঁদাবাজি, জায়গা দখল-বেদখল, মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত হচ্ছে এসব অবৈধ অস্ত্র।
এরই মধ্যে আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে জোর প্রস্তুতি শুরু করেছে সরকার।
গত ৬ মাসে চট্টগ্রামের ৩ শতাধিক ঘটনায় অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে। সেই সাথে মব সন্ত্রাস এখনও সম্পূর্ণ বন্ধ হয়নি। এমন পরিস্থিতি আগামী নির্বাচনের সময় উদ্ধার না হওয়া এসব মারণাস্ত্র ও গোলাবারুদ সহিংসতার ঝুঁকি বাড়াতে পারে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
তবে স্বরাষ্ট উপদেষ্টাসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, সুন্দর ও সুষ্ঠু ভোট অনুষ্ঠানে তারা সম্পূর্ণ প্রস্তুত।
পুলিশের দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধারে ইন্টেলিজেন্সভিত্তিক অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে সুনির্দিষ্টভাবে অভিযান চালিয়ে সন্ত্রাসী ও দুর্বৃত্তদের গ্রেপ্তার ও অস্ত্র উদ্ধারে জোর দেওয়া হচ্ছে। এরই মধ্যে অস্ত্র উদ্ধারে পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। একটা শর্ট গান কিংবা পিস্তল উদ্ধার করে দিতে পারলে ৫০ হাজার টাকা এবং চায়না রাইফেল ও এসএমজি উদ্ধার করে দিতে পারলে এক লাখ টাকা করে পুরস্কার দেওয়া হবে। এলএমজির ক্ষেত্রে ৫ লাখ টাকা এবং প্রতি রাউন্ড গুলির জন্য পুরস্কার দেওয়া হবে ৫০০ টাকা। এই পুরস্কারের টাকা বাহিনীর সদস্যসহ সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে।
অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধারে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে অনলাইন ও অফলাইনে। তারপরও উদ্ধার না হওয়া অস্ত্র ও গোলাবারুদ নির্বাচনি প্রচারণা ও ভোটকেন্দ্রে ভয় তৈরিতে ব্যবহার করা হতে পারে বলেও আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। সন্ত্রাসীরা এসব অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে রাজনৈতিক সহিংসতায় লিপ্ত হলে তা রাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়তে পারে। ব্যাহত হবে নির্বাচনি কর্মকাণ্ড।
সূত্রমতে, চট্টগ্রাম জেলার বিভিন্ন স্থানে অবৈধ অস্ত্রের গোপন বাজার গড়ে উঠেছে। সূত্র ধরে কৌশলে টাকা ছাড়লেই বাজারে মিলছে দেশি বিভিন্ন অস্ত্র। এছাড়া জেলার পাহাড়ি ও উপকূলীয় বিভিন্ন স্থানে এলজি, পাইপগান, ওয়ান শ্যুটারগান ও একনলা বন্দুক তৈরি হচ্ছে।
বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কাছে আসামিরা জানিয়েছে, চট্টগ্রামের বাঁশখালী, রাঙ্গুনিয়া, কক্সবাজারের কুতুবদিয়া, মহেশখালীসহ বিভিন্ন পাহাড়ি ও উপকূলীয় এলাকায় তৈরি হচ্ছে এসব অবৈধ অস্ত্র। তবে ভারত ও মায়ানমার সীমান্ত পার হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম দিয়েও অবৈধ অস্ত্র আসছে চট্টগ্রাম জেলার সন্ত্রাসীদের কাছে। গত বছরের জুলাই আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর যেসব অস্ত্র থেকে গুলিবর্ষণ করা হয় তার বেশির ভাগই উদ্ধার করা হয়নি।
পর্যবেক্ষক ও সংশ্লিষ্ট অনেকে বলছেন, চট্টগ্রামে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার বেড়েছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ও পরে এসব অস্ত্র ব্যবহার হতে পারে। এসব অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারই এখন চট্টগ্রামে র্যাব-পুলিশের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। চট্টগ্রামে পুলিশের অভিযানে প্রতিনিয়ত এসব অস্ত্র-গুলি উদ্ধার করা হলেও সে তুলনায় সন্ত্রাসীদের গোপন আস্তানায় থাকা অস্ত্র উদ্ধারে তেমন সাফল্য নেই।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এমনিতেই জেলা এবং মহানগরীতে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার বাড়ছে। এ অবস্থায় অপরাধীদের আস্তানায় থাকা অস্ত্র গোলাবারুদের মজুদ উদ্ধার করা না গেলে সামনে পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতি হতে পারে। নির্বাচনকে ঘিরে রাজনীতিতে মেরুকরণের পাশাপাশি অস্ত্রবাজদের মধ্যেও নানা মেরুকরণ হবে। তখন এসব অস্ত্রধারীদের কদরও বেড়ে যাবে। আবার নির্বাচন বানচালে পরাজিত শক্তি নানা অঘটন ঘটাতে পারে। সেই নাশকতামূলক কাজেও অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার হতে পারে। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়েই এখন থেকে অস্ত্র উদ্ধারে অভিযান জোরদার করা জরুরি বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
জানা গেছে, গত জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চট্টগ্রাম মহানগর ও জেলা পুলিশ এবং র্যাব মিলে চট্টগ্রাম থেকে ১৪৫টি অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করেছে।
র্যাব-৭-এর সহকারী পরিচালক (মিডিয়া) এ আর এম মোজাফফর হোসেন বলেন, চট্টগ্রামে দেশীয় আগ্নেয়াস্ত্র অনেকেই তৈরি করে। তথ্য পেলেই আমরা অভিযান পরিচালনা করছি। সাধারণত চট্টগ্রামের উপকূলীয় এলাকায় অস্ত্র তৈরি হয়। এছাড়া কুতুবদিয়া, মহেশখালীতেও দেশীয় অস্ত্র তৈরি হয় বলে আসামিদের কাছ থেকে জানতে পেরেছি।