কনকনে শীতের রাতে রাস্তায় ভাইয়ের উষ্ণতা হয়ে উঠলো বড় বোন

আপডেট : ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৩:২৯ এএম

কনকনে শীতের রাতে রাস্তার পাশে বসে ছিল দুই শিশু। না ছিল গায়ে পর্যাপ্ত কাপড়, না ছিল পাশে কোনো অভিভাবক। ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে ছোট ভাইকে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে বসে ছিল চার বছরের বড় বোন।

সেই হৃদয়বিদারক দৃশ্যই চোখে পড়ে চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার ৬ নম্বর বারখাইন ইউনিয়নের শোলকাটা এলাকায়।

রোববার (২৮ ডিসেম্বর) রাতে স্থানীয়দের চোখে পড়লে পরিত্যক্ত অবস্থায় দুই শিশুকে উদ্ধার করা হয়। পরে খবর পেয়ে আনোয়ারা থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে শিশু দুটিকে নিজেদের হেফাজতে নেয়।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, উদ্ধার হওয়া শিশুদের মধ্যে বড়টি মেয়ে আয়েশা আক্তার (৪) এবং ছোটটি ছেলে মোরশেদ (২)। শিশুদের মায়ের নাম ঝিনুক আক্তার। আয়েশার ভাষ্যমতে, তাদের বাড়ি সাতকানিয়া থানাধীন মৌলভি দোকানের পাশের একটি এলাকায়।

স্থানীয়দের ভাষ্য অনুযায়ী, সন্ধ্যার পর থেকেই শিশু দুটিকে রাস্তার পাশে বসে থাকতে দেখা যায়। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শীত আরও তীব্র হয়। তবুও দুই শিশু সেখানেই পড়ে ছিল। বড় বোন আয়েশা ছোট ভাই মোরশেদকে আগলে রাখার চেষ্টা করছিল যেন নিজের শরীরের উষ্ণতা দিয়েই ভাইকে রক্ষা করতে চায়।

আনোয়ারা থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মোমেন বলেন, রাতে ৯৯৯ নম্বরে ফোন পেয়ে আমরা ঘটনাস্থলে যাই। পরে শিশু দুটিকে উদ্ধার করে আনোয়ারা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, ছোট শিশুটির জন্মগত একটি রোগ রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে এবং বড় শিশুটির চর্মরোগ রয়েছে।

শিশুদের বরাতে জানা যায়, তাদের মা শোলকাটা এলাকার রাস্তার পাশে রেখে চলে যান। পরে স্থানীয় একটি পরিবার মানবিকতার পরিচয় দিয়ে শিশু দুটিকে নিজেদের হেফাজতে নেয় এবং বিষয়টি স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনকে জানায়।

আশ্রয়দাতা মহিম উদ্দিন জানান, সন্ধ্যার পরও শিশু দুটিকে রাস্তায় বসে থাকতে দেখে মানুষের ভিড় হয়। পরে আমি গিয়ে বড় শিশুটির সঙ্গে কথা বলি। সব শুনে তাদের বাসায় নিয়ে আসি এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের জানাই।

মহিমের স্ত্রী শারমিন আক্তার বলেন, দুই শিশুই অসুস্থ ছিল। ছোট শিশুটি প্রতিবন্ধী বলেও মনে হয়েছে। আমরা গরম পানি দিয়ে গোসল করিয়ে খাবার খাইয়ে দিই। এরপর তারা একটু স্বস্তি পায়। আমাদের ধারণা, শিশুদের অসুস্থতার কারণেই মা-বাবা এমন নিষ্ঠুর কাজ করেছে।

ঘটনাটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। অনেকেই শিশুদের নিরাপত্তা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন।

বর্তমানে শিশু দুটো আনোয়ারা উপজেলা সমাজসেবা অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে রয়েছে। আনোয়ারা উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা রিজোয়ান আহমেদ কালবেলাকে বলেন, শিশুগুলো বর্তমানে উপজেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে আনোয়ারা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন রয়েছে। চিকিৎসা শেষে আশ্রয়দাতার কাছেই রাখা হবে। একই সঙ্গে তাদের স্বজনদের খোঁজে বিভিন্ন উপজেলা প্রশাসনকে অবহিত করা হয়েছে।

স্থানীয় প্রশাসনের সূত্রে জানা যায়, শিশু দুটো নিবিড় পর্যবেক্ষণে চিকিৎসা নিচ্ছে। সমাজসেবা অধিদপ্তরের মাধ্যমে তাদের নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হবে এবং উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আর্থিক সহায়তাও দেওয়া হবে। এ ছাড়া, এখন পর্যন্ত শিশুদের কোনো স্বজনের সন্ধান পাওয়া যায়নি এবং বিষয়টি আশপাশের উপজেলা প্রশাসনগুলোকে জানানো হয়েছে।

কনকনে শীতের সেই রাতে বড় বোনের ছোট ভাইকে আগলে রাখার দৃশ্য এখনো অনেকের চোখে ভাসছে। বাবা-মায়ের নিষ্ঠুর অবহেলার মাঝেও দুই শিশুর সেই নিঃশব্দ লড়াই যেন সমাজকে নতুন করে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।

HN
আরও পড়ুন