প্রযুক্তির ছোঁয়ায় শিকড়ে ফিরছে ঢেঁকিছাঁটা চাল 

কালের বিবর্তনে হারিয়ে পুনরায় আধুনিক প্রযুক্তি ছঁয়া ফিরেছে ঢেঁকিছাঁটা চাল। এ যেন নিজ সত্তাকে শিকড়ে ফিরিয়েছে।
 
সরেজমিনে দেখা যায়, মানিকগঞ্জের ঘিওরের কান্দারিয়ায় দুটি বৈদ্যুতিক ঢেঁকি দিয়ে চাল উৎপাদন করছে আক্তার হোসেন (৫২)। প্রথম দিকে নিজের জন্য উৎপাদন করলেও এখন বানিজ্যিকভাবে শুরু করে চাল উৎপাদন।
 
এক সময় গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য কাঁঠের ঢেঁকি ছিল প্রতিটি বাড়িতেই। চাল উৎপাদনের একমাত্র মাধ্যম ছিল ঢেঁকি। তবে কালের বিবর্তনে হারিয়ে গিয়ে ছিল। তবে পুনরায় আধুনিক প্রযুক্তির আদলে ফিরেছে ঢেঁকি। এখন চাল তৈরি হয় যান্ত্রিক মেশিনে। যদিও সেই আগের মতো নেই ঢেঁকির ‘ধুপ ধুপ’ আওয়াজ। 
মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার কুন্দরিয়ায় আক্তার হোসেন (৫২) নামের এক উদ্যোক্তা ইলেকট্রিক ঢেঁকি স্থাপন করে আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন। প্রথম দিকে তার এই উদ্যোগকে পাগলামিই মনে করেছিলেন স্থানীয়রা।
 
তিনি জানান, ২০২০ সালে তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হন। তখন চিকিৎসক তাকে প্রোটিন জাতীয় খাবার খেতে বলেন। তার মধ্যে বিশেষভাবে বলা হয় লাল চালের ভাতের কথা। বাজার থেকে চাল কিনে রান্না করার সময় চালের রং উঠে যেত, বারবার দোকান পরিবর্তন করেও কোন সমাধান হয়নি। 
 
পরে আক্তার নিজের জন্যই এই ঢেঁকিছাঁটা চালের ব্যবস্থা করেন। প্রতিবেশী ও আত্মীয়-স্বজনদের কিছু কিছু চাল দিতেন। পরে চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় বানিজ্যিকভাবে শুরু করেছেন চাল উৎপাদন। মানুষ সুস্বাস্থ্য ও পুষ্টির কথা বিবেচনায় ঢেঁকি ফিরতে শুরু করেছে শিকড়ে। মেশিনের চালে ফাইবারসহ প্রয়োজনীয় ভিটামিন কম থাকে। ঢেঁকিছাঁটা আমনের চালে তুষ অক্ষত থাকে। আর এতে লুকিয়ে আছে মূল পুষ্টি গুণ।
চিকিৎসকরা বলছেন, ঢেঁকিছাঁটা চালে প্রচুর পরিমাণে ম্যাগনেসিয়াম, ভিটামিন বি, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং পর্যাপ্ত ফাইবার থাকে। পরিমিত প্রোটিন থাকায় মানবদেহে হজমশক্তি বৃদ্ধি, ডায়াবেটিস, ওজন কমানোসহ হার্টের জন্য বেশ উপকারী।
 
গ্রামের বিভিন্ন স্থান থেকে আমন ও আউশ ধান ক্রয় করে আক্তার ঢেঁকিঘরে এনে তা প্রক্রিয়া করে বাজারজাত করছেন আক্তার হোসেন। তার এই ঢেঁকিঘরে দুইজন নারীসহ মোট ৪ জন সার্বক্ষণিক কাজ করছে। আক্তারের এই ঢেঁকিছাঁটা চাল নিজ জেলার চাহিদা মিটিয়ে প্রায় ৪০টি জেলা থেকে অর্ডার আসছে। নিজের প্রয়োজন ও শখের বসে ঢেঁকিঘর স্থাপনে তিনি এখন হচ্ছেন আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী। স্বাদে ভালো ও স্বাস্থ্যসম্মত চাল উৎপাদন এ যেন এক অপূর্ব মেলবন্ধন। নিরাপদ খাদ্য তৈরির এই নতুন দিগন্তের উন্মোচনে উদ্যোক্তাদের প্রয়োজন সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা। 
 
ঘিওরের কান্দারিয়া এলাকার ষাটোর্ধ বাসিন্দা শহিদুল ইসলাম বলেন, আমি ছোট সময় থেকেই আমন আউশের ভাত খেয়ে বড় হয়েছি। ওই সময় আমাদের রোগ-বালাই কম ছিল। ঢেঁকিছাঁটা চালের ভাতের মারও অনেক পুষ্টিকর। এখনতো আর আগের মতো কেউ ঢেঁকিতে চাল তৈরি করে না। তবে আক্তার হোসেন যে ঢেঁকি দিয়ে চাল তৈরি করছে, তা এখন যেন নিজ সত্তাকে পুনরায় শিকড়ে ফেরাচ্ছে।
একই এলাকার শিখা রানী বলেন, আমাদের ঠুকুমার মুখে শুনেছি, তাদের সময় নাকি ভোর রাত থেকে ঢেঁকিছাটা চাল তৈরির জন্য হাড়ভাঙা খাটুনি করতে হয়েছে। আর সেই পরিশ্রমের পরিত্রান ঘটিয়েছে মেশিনের চাল। তবে পুষ্টিগুণের বিবেচনায় ফিরতে শুরু করেছে ঢেঁকিছাঁটা চাল। প্রতিদিন এই ঢেঁকিঘরে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মানুষ এসে আমন ধানের লাল চাল নিয়ে যাচ্ছে।
 
ঢেঁকিঘরের ম্যানেজার জুসন আলী বলেন, আমাদের এই ঢেঁকিঘরে ভাওয়াইলা জাতের আমন ধান ও কাঁলো মানিক নামের আউশ ধানের চাল উৎপাদন হচ্ছে। প্রতিদিন গড়ে পাঁচ মণ ধানে প্রায় চাঁর মণ চাল তৈরি হয়। বর্তমানে উৎপাদনের চেয়ে চাহিদা বেশি।
 
ওই ঢেঁকিঘরের এক নারীকর্মী মনোয়ারা বেগম বলেন, মা-দাদিরা ঢেঁকিতে চাল তৈরি করতো কষ্ট করে,  সেই দিনতো আর নাই। আধুনিকতার ছোঁয়ায় ঢেঁকি চলছে। আর ঢেঁকিতে চাল তৈরির কারণে দূরদূরান্ত থেকে অর্ডার আসছে। 
উদ্যোক্তা ঢেঁকিঘরের আক্তার হোসেন বলেন, বেশ কয়েক বছর আগে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছি আমি। ডাক্তার নিয়ম মেনে চলার পাশাপাশি লাল চালের ভাত খাওয়ার পরামর্শ দেন। বাজার থেকে লাল চাল কিনে রান্না করতে গেলে চালের উপর পলিশ করা রং উঠে যেতো। এই সমস্যার কারণে অনেক দোকান বদলেছি। কিন্তু কোন লাভ হয়নি। পরে বাধ্য হয়েই নিজের খাওয়ার জন্য এই বৈদ্যুতিক ঢেঁকি স্থাপন করি। প্রথম দিকে প্রতিবেশীরা পাগলামি বললেও পরে প্রশংসাও করছে। শুরুতে নিজের জন্য হলেও পরে চাহিদা বাড়ায় বানিজ্যিকভাবে শুরু করেছি চাল উৎপাদন। 
 
২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার ডা. এ.বি.এম তৌহিদুজ্জামান সুমন বলেন, বাজারের সাদা চালের মধ্যে অনেক ক্যেমিক্যাল থাকে, যা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। তবে ঢেঁকিছাঁটা চালে এই প্রভাব নাই। এ চালে প্রচুর পরিমাণে পুষ্টি রয়েছে। 
 
বিসিক মানিকগঞ্জ কার্যালয়ের উপ-ব্যবস্থাপক আব্দুল কাদের বলেন, বাজারের চালের চেয়ে ঢেঁকিছাঁটা চালের উপকারিতা অনেকাংশেই বেশি। এটার প্রচার ও প্রসারটা বাড়ানো গেলে উদ্যোক্তারা বানিজ্যিকভাবে লাভবান হবেন। বিসিকের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে।