ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার পাইকপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির আখড়া হিসেবে পরিণত হয়েছে। এসবের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে একাধিক অভিযোগ জমা পড়লেও আমলে নেননি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ। সম্প্রতি শিশু শ্রেণি কক্ষ সজ্জিতকরণ বরাদ্দের টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা দিলরুবা আক্তার ও সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ছদরুল আলমের বিরুদ্ধে।
জানা যায়, উপজেলার মনোহরপুর ইউনিয়নে অবস্থিত পাইকপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৈরি হয় নতুন ভবন। এর আগে বিদ্যালয়ের একটি পুরাতন ভবনেই চলত শিক্ষার্থীদের পাঠদান। লিখিত অভিযোগের ভিত্তিতে জানা যায়, শিশু শ্রেণি কক্ষে সজ্জিতকরণের নির্দেশনা থাকলেও ক্ষমতার দাপটে সেটাকে তোয়াক্কা না করে বরাদ্দকৃত অর্থ আত্মসাত করেছেন স্কুলের সাবেক প্রধান শিক্ষিকা দিলরুবা আক্তারসহ কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারি।
সরেজমিনে ওই স্কুলে গিয়ে দেখা যায়, স্কুলটিতে সজ্জিতকরণের কোন চিহ্ন নেই। একেবারেই সাদামাটা শ্রেণিকক্ষের মধ্যেই চলছে ক্লাস। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতি বছর স্কুলের শিক্ষার মান উন্নয়নে সরকার বরাদ্দ দিচ্ছে। তার মধ্যে শিশু শ্রেণি সজ্জিত উপকরণ বাবদ বিশ হাজার টাকা সরকার দিয়ে থাকেন।
বিদ্যালয়ের এক সহকারী শিক্ষক জানান, গত অর্থ বছরে বিদ্যালয়ের শিশু শ্রেণি সজ্জিতকরণ করার জন্য প্রতিবছর বরাদ্দ আসে দশ হাজার টাকা। সেই হিসেবে গত দুইবারের বরাদ্দ বিশ হাজার টাকা। করোনাকালীন সময় থেকে এ পর্যন্ত বরাদ্ধকৃত টাকার কিছুই করা হয়নি। এ বাবদ কত টাকা আসে আর কোন খাতে খরচ হয় সেটা সাবেক প্রধান শিক্ষকই বলতে পারেন।
এ বিষয়ে একাধিক শিক্ষক বলেন, বরাদ্দের টাকা কবে আসে আর সাবেক প্রধান শিক্ষিকা দিলরুবা আক্তার কি করেছেন সে বিষয়ে তিনিই ভাল বলতে পারবেন। স্কুলে আগে একটা পুরাতন বিল্ডিং ছিল সেখানে একটা রুমের মধ্যে শিশু ও তৃতীয় শ্রেণির ক্লাস করা হতো। সেখানে শ্রেণি সজ্জিত করণের উপকরণ ক্রয় করার প্রশ্নই আসে না। তবে মহামারী করোনার আগে একবার সামান্য কিছু রং ডাস্টার সহ কিছু কিনতে দেখেছিলাম। স্কুলে সরকারি টাকা যা আসে সব তার একাউন্টেই আসে।
স্কুলের সাবেক সহকারী শিক্ষিকা আছমা খাতুন বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগে জানান, ‘প্রধান শিক্ষিকা দিলরুবা ও প্রাথমিক সহকারী শিক্ষা অফিসার ছদরুলের যোগসাজশে অনেক অর্থকড়ি নয় ছয় হয়েছে। তাদের অনিয়ম দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমিসহ অবিভাবকরা লিখিত অভিযোগ দিলেও কোন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়নি কর্তৃপক্ষ। বরং অভিযোগকারীদের সাথে অপমানজনক আচরণ করে তদন্ত ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে। যার আজ পর্যন্ত সুরাহা হয়নি।’
ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক রাজিব আল মাহমুদ বলেন, ‘আমি এর আগেও এই স্কুলে সহকারী শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলাম। প্রধান শিক্ষিকা বদলিজনিত কারণে বর্তমানে আমি ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে আছি। অর্থ বরাদ্দের এ সমস্ত টাকা তছরুপ করার ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি দায়িত্ব গ্রহণের পরে কোন বরাদ্দ পায়নি। আর সাবেক হেড ম্যাডামের ব্যাপারে বিগত দিনে ব্যাপক অনিয়ম দুর্নীতির বিরুদ্ধে বেশ অনেকবার এলাকাবাসী সহকারী শিক্ষকসহ অভিভাবকদের অনেকেই বসাবসি ও শিক্ষা অফিসে লিখিত অভিযোগ দিলেও কোন ফল হয়নি। তখন আমরা সহকারী শিক্ষকগণ তার ভয়ে কেউ কথা বলতে পারতাম না।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই স্কুলের আরো একাধিক শিক্ষক বলেন, প্রধান শিক্ষিকা দিলরুবাকে রক্ষা করতে তড়িঘড়ি করে অন্যত্র বদলি করা হয়েছে। এছাড়া তার সকল অনিয়ম দুর্নীতির তদন্ত ধামাচাপা দেয়া হয়েছে।
বিদ্যালয়ের মাঠে বেশ কিছু ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তারা জানায়, বিদ্যালয়ের শিশু শ্রেণি সজ্জিতের কোন কিছু তারা দেখেনি।
কয়েকজন স্থানীয় অভিভাবকদের কাছে জানতে চাইলে তারা বলেন, সাবেক প্রধান শিক্ষিকার খুটির জোরের অভাব নেই। স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী হওয়ায় তার ভয়ে কেউ কিছু বলতে সাহস পায় না। স্কুলের পুরাতন ভবনের গোডাউনে প্রচুর পুরাতন আসবাবপত্র ছিল, সেসব মালামাল পিয়ন রবিউলের সহযোগিতা ও শিক্ষা অফিসের অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে প্রধান শিক্ষিকা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াই বিক্রি করে দেন। এসব বিষয়েও আমরা টিও অফিসে লিখিত অভিযোগ দিয়েও সঠিক তদন্তের অভাবে আলোর মুখ দেখেনি।
এ ব্যাপারে সাবেক প্রধান শিক্ষিকা দিলরুবা আক্তার জানান, বরাদ্দের টাকা সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ছদরুল আলমের কাছে গচ্ছিত থাকলেও কি কারণে তিনি লুকাচ্ছেন বিষয়টি বলতে পারছি না। এছাড়া অন্যান্য অভিযোগের তদন্ত চলমান আছে।
এ বিষয়ে উপজেলা প্রাথমিক সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা ছদরুল আলম জানান, সহকারী শিক্ষিকা আছমা খাতুনের অভিযোগ তদন্ত করে জেলায় পাঠানো হয়েছে। পরবর্তী পদক্ষেপ জানা নেই।
জেলা শিক্ষা অফিসার আনন্দ কিশোর সাহা জানান, সংশ্লিষ্ট অভিযোগ যথাযথভাবে তদন্ত না হওয়ায় উক্ত ফাইল পুনরায় তদন্তের জন্য ফেরত পাঠানো হয়েছে। উপজেলা শিক্ষা অফিসার বিষয়টি ভালো বলতে পারবেন।
এ ব্যাপারে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার (ভারপ্রাপ্ত) শাহীন আক্তার বলেন, পাইকপাড়া স্কুল সংক্রান্ত পূর্বে প্রকাশিত খবর এবং আছমা খাতুনের অভিযোগ তদন্ত করে জেলা শিক্ষা অফিসে পাঠানো হয়েছে। তদন্তের স্বার্থে গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়েছে। তবে, অভিযোগের সত্যতা মিলেছে কিনা এ ব্যাপারে তিনি বক্তব্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন।