প্রয়োজন সংস্কার-সংরক্ষণ

ভগ্নদশায় দাঁড়িয়ে ২৬০ বছরের পুরোনো মঠবাড়ি মন্দির

মঠবাড়ি মন্দির। মধ্যযুগীয় পুরাকীর্তির নিদর্শন। সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার সোনাবাড়িয়ায় আজো দাঁড়িয়ে আছে স্বমহিমায়।

তবে অযত্ন-অবহেলা আর সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ভগ্নাদশায় রূপ নিয়েছে ঐতিহাসিক এই স্থাপনাটি। ৩ তলা বিশিষ্ট এই পুরাকীর্তিটি নবরত্ন মন্দির বা শ্যামসুন্দর মন্দির নামেও পরিচিত।

উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে সোনাবাড়িয়া গ্রামে ঐতিহাসিক এই প্রত্নস্থলটির অবস্থান। ২৬০ বছরের পুরোনো ৬০ ফুট উঁচু টেরাকোটা ফলক খচিত পিরামিড আকৃতির এই মঠ-মন্দির প্রাচীন স্থাপত্যের অপরূপ নিদর্শন হয়ে আজো দাঁড়িয়ে আছে।

এখনো প্রতিদিন নানান বয়সী দর্শনার্থীরা সেখানে যান সময় কাটাতে, পিকনিকও করেন অনেকে। মঠবাড়ি মন্দিরকে ঘিরে বিনোদন ও পর্যটন স্পট হওয়ার হাতছানি বারবার দেখা দিলেও কার্যকর পদক্ষেপের অভাবে সেটা সম্ভব হয়নি। জরাজীর্ণ ও ভগ্নপ্রায় এই ঐতিহাসিক মঠ-মন্দিরটি সংস্কার ও সংরক্ষণ করা না গেলে একটি ঐতিহাসিক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন বিনষ্ট হতে পারে।

প্রত্নতত্ত অধিদপ্তরের সাবেক উপ-পরিচালক মো. মোশারফ হোসেনের লেখা ‘প্রত্নতাত্তিক জরিপ প্রতিবেদন বৃহত্তর খুলনা’ বইটিতে উল্লেখ করা হয়েছে, এ মন্দিরটি ১৭৬৭ খ্রিষ্টাব্দে জনৈক হরিরাম দাশ (মতান্তরে দুর্গাপ্রিয় দাশ) নির্মাণ করেছিলেন। যেটি সতীশ চন্দ্র মিত্রের বইয়েও উল্লেখ রয়েছে।

অনুরূপ উল্লেখ আছে, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও লেখক প্রফেসর মো. আবু নসর কর্তৃক রচিত ‘কলারোয়া উপজেলার ইতিহাস’ বইয়েও।

সরেজমিনে গিয়ে জানা গেছে, এই পুরাকীর্তিটি ত্রি-তল বিশিষ্ট নবরত্ন মন্দির। এটিই ‘শ্যামসুন্দর মন্দির’ নামে পরিচিত। এর সাথে লাগোয়া রয়েছে দুর্গামন্দির ও শিবমন্দির। দেখতে মন্দিরটি একটি পিরামিড আকৃতি ধারণ করেছে। দক্ষিণমুখী এই মন্দিরের নিচের তলার ভেতরের অংশে ৪টি ভাগ রয়েছে। প্রথম ভাগের চারপাশে রয়েছে ঘূর্ণায়মান টানা অলিন্দ। দ্বিতীয় ভাগে রয়েছে একটি মন্ডপ।

তৃতীয় ভাগের পশ্চিম পাশের কোঠা এবং মাঝের কোঠাটির উত্তরে একটি করে প্রকোষ্ঠ রয়েছে। পূর্বাংশের কোঠাটির পেছনে রয়েছে একটি অলিন্দ, যেখানে দ্বিতল ভবনে ওঠার সিঁড়ি রয়েছে।

ধারণা করা যায়, পূর্ব ও পশ্চিম কোঠা দুটিতে সংরক্ষিত মূর্তির উদ্দেশ্যে মন্দিরটি নিবেদিত ছিল। দ্বিতলে রয়েছে একটি দক্ষিণমুখী কোঠা। ত্রি-তল ভবনটি তুলনামূলক ছোট। এর দক্ষিণ দিকের মধ্যের খিলানটির ওপর একটি পোড়ামাটির ফলক রয়েছে। এই মন্দিরগুচ্ছের দক্ষিণে একটি অসম বাহুবিশিষ্ট চৌকো দিঘি আছে। বর্তমানে এ মন্দিরগুচ্ছ পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। এই মঠের পাশে আরো ৮টি
(মতান্তরে ১০টি) মন্দির ছিল।

মঠ মন্দিরগুচ্ছের অল্প দক্ষিণে ‘জমির বিশ্বাসের পুকুর’ নামে যে জলাশয়টি আছে সেটির পাকাঘাটে ব্যবহৃত ইটের সাথে ‘অন্নপূর্ণা মন্দির’ এর ইটের মিল পাওয়া যায়। তাতে ধারণা করা হয়, পুকুরটি একই সময়কালের নিদর্শন। বর্তমানে এই ঐতিহাসিক পুকুরটি বিষমবাহুর আকার ধারণ করেছে। বিশিষ্ট লেখক প্রফেসর আবু নসরের লেখা ‘কলারোয়া উপজেলার ইতিহাস’ বইতেও এই প্রাচীন মঠটি সম্পর্কে অনুরূপ তথ্য-উপাত্ত উল্লেখিত রয়েছে।

লেখক মোশারফ হোসেনের ওই জরিপ বইয়ে আরো বলা হয়েছে- শ্যামসুন্দর মঠের নিচে রয়েছে একটি উঁচু নিরেট মঞ্চ। এর প্রত্যেক তলার ছাদপ্রন্ত ধনুকের মত বাঁকা। কোণগুলো কৌণিক। এগুলোর ছাদের ওপর ক্রমান্বয়ে ধাপে ধাপে ঊর্ধ্বমুখী গম্বুজ রয়েছে। আর মাঝখানে তুলনামূলক বড় একটি রত্ন রয়েছে। এটি তাই ‘নবরত্ন স্মৃতি মন্দির’।

নবরত্ন বা শ্যামসুন্দর মঠের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে আরও একটি দক্ষিণমুখী মন্দির আছে। এটি ‘দুর্গা মন্দির’ নামে পরিচিত। শ্যামসুন্দর মন্দিরের গা ঘেঁষে পূর্বমুখী মন্দিরটিতে ৩ ফুট উঁচু একটি কালো পাথরের শিবলিঙ্গ আছে। এর ওপর একটি ভাষ্য ফলক পাঠোদ্ধার অনুপযোগী অবস্থায় সংস্থাপিত আছে। এর ছাদ চৌচালা, কার্ণিশ ধনুকাকারে বাঁকা এবং কোণগুলো কৌণিক। এটি ‘অন্নপূর্ণা মন্দির’ নামে পরিচিত। এগুলো গাঁথা হয়েছে চুন ও সুরকি মিশ্রিত মসলা দিয়ে।

অনেকের মতে, রামহংস পরমানন্দ এক সময় মন্দিরগুলো পরিদর্শনে এসেছিলেন।

জানা গেছে, ২০১৪ সালের ২৬ অক্টোবর এই মঠ-মন্দির সরেজমিনে পরিদর্শনকালে তৎকালীন ভারতীয় ডেপুটি হাইকমিশনার সদ্বীপ চক্রবর্তী ঐতিহাসিক এই স্থাপনা সংস্কার ও সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তার গুরুত্বারোপ করেছিলেন।

২০২২ সালের ১৯ মার্চ মঠবাড়ি শ্যামসুন্দর মন্দির পরিদর্শন করেন তৎকালীন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় সহকারী হাইকমিশনার রাজেশ কুমার রায়না। সে সময় সাথে ছিলেন তার স্ত্রী নন্দিতা রায়। পরিদর্শনে এসে তারা পূজা আর্চনাও করেন। সে সময় রাজেশ কুমার রায়না বলেন, ইতিহাস-ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে সকলের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস দরকার।

২০২২ সালের ২০ এপ্রিল মঠবাড়ি মন্দির পরিদর্শনে এসে তৎকালীন ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের সচিব ডা. দীলিপ কুমার ঘোষ বলেন, ‘খুব শিঘ্রই শ্যামসুন্দর মঠবাড়ি মন্দির সংরক্ষণে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’ তবে আজো সেটা হয়নি।

এর আগে ২০২২ সালের ১০ এপ্রিল মঠবাড়ি (শ্যামসুন্দর মন্দির) পরিদর্শন করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রতিনিধি দল। তারা সে সময় একটি গবেষণার অংশ হিসেবে মঠ মন্দিরটি পরিদর্শন করেন।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নুরুল কবির, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মাকসুদ রেজা, দারাইনসহ প্রতিনিধিদল মঠবাড়ি সংরক্ষণে সরকারি উদ্যোগের উপর গুরুত্বারোপ করেন।

এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ, খুলনা জাদুঘর, বিভিন্ন বিশ^বিদ্যালয়ের টিমসহ বিভিন্ন দপ্তর থেকে এটি পরিদর্শন করা হয়েছে। তবে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ এখনো সেভাবে দৃশ্যমান হয়নি।

এলাকার মানুষ জানান, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ মন্দিরগুচ্ছের সংরক্ষণের দায়িত্ব নিক। 

সোনাবাড়িয়া সম্মিলিত হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক আখতার আসাদুজ্জামান চান্দু বলেন, এই পুরাকীর্তি সংরক্ষণ করা হলে এটি সকলেরই নজর কাড়বে। শিক্ষার্থীদেরও আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে এটি পরিণত হবে।

এলাকার অনেকের মতে, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে ঐতিহাসিক এই স্থাপনা সংস্কার ও সংরক্ষণ করা গেলে এটি হতে পারে সনাতন ধর্মাবলম্বীসহ পুরাকীর্তিপ্রেমী মানুষের কাছে দর্শনীয় স্থান ও আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্র।