আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বাসিন্দা আর্নিশ মান্দা (৫০)। স্ত্রী ও দুই ছেলে এবং দুই মেয়ে নিয়ে তার সংসার। তার প্রয়াত বাবা অবিনাশ বাজি ছিলেন একজন সংগীতশিল্পী। নিয়মিত বেতার-টেলিভিশনে গান করতেন। তিন ভাই-বোনের মধ্যে আর্নিশ মান্দা দ্বিতীয়। আর্নিশ ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার ধাইরপাড়া গ্রামের বাসিন্দা।
১৯৬৯ সালে উপজেলার সাপমারি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি গারো ভাষায় ও আচিক মান্দিরাং, আফসানংবো নাসিমাং’ এই জনপ্রিয় গানের স্রষ্টা। এটি মূলত গারো জনগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষায় রচিত জাগরণের গান। যে গানে সময়ের সঙ্গে নিজস্ব কৃষ্টি-কালচার নিয়ে টিকে থাকার জন্য সবাইকে এক হওয়ার আহ্বান জানিয়ে গানটি লিখেছেন শিল্পী আর্নিশ মান্দা। কিন্তু গান মনে রাখলেও তাকে মনে রাখেনি কেউ।
নির্মম বাস্তবতায় প্রতিভাবান এই শিল্পী এখন দিনমজুর। একচালা ‘ছাপরা ঘরে’ জসীম উদ্দীনের ‘আসমানি’র মতো জীবনযাপন করছেন শিল্পী আর্নিশ মান্দা। সমতলের ক্ষুদ্র জাতিসত্তাকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে লেখা গানটি বেশ সমাদৃত।
ঐতিহ্যবাহী ‘ওয়ানগালা’ উৎসব থেকে শুরু করে যেকোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে জাগরণের সেই গানটি শোনা যায়। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে ভারতের আসাম-মেঘালয়ের গারোদের কাছেও বেশ জনপ্রিয়। মান্দার এই জনপ্রিয় গান সমতল ছাড়িয়ে পাহাড়ও নাচে।
আর্নিশ মান্দা বাল্যকালে পার্শ্ববর্তী হালুয়াঘাট উপজেলার চর বাঙ্গালীয়া গ্রামে আত্মীয়ের বাড়িতে লজিং থেকে পড়াশোনা করতেন। ১৯৯৩ সালে চর বাঙ্গালীয়া মনিন্দ্র রেমা নাইট মেমোরিয়াল হাইস্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন। দারিদ্রতার সাথে লড়াই করে বিএসএস সম্পন্ন করেন। এরপর জীবিকার প্রয়োজনে পাড়ি জমিয়েছেন গাজীপুরে, কাজ করেছেন কয়েকটি ওষুধ এবং পোশাক কারখানায়। বাবা একজন সংগীত শিল্পী হওয়ায় ছোটকাল থেকেই গানের প্রতি অনুরাগ ছিল মান্দার।
বাবা অবিনাশ বাজিও তাকে কোলে নিয়ে তবলা-হারমোনিয়ামসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান করতেন। তখন থেকেই গান পছন্দ করেন আর্নিশ মান্দা। কিন্তু আর্থিক দৈন্যদশায় কোনো সংগীত শিল্পীর কাছে থেকে তালিম নিতে পারেননি। তার পরও দমে যায়নি। ধীরে ধীরে নিজেকে মেলে ধরতে শুরু করেন আর্নিশ মান্দা। নিজেই গান লিখে নিজেই সুর দিয়ে গান গাইতে থাকেন। এ পর্যন্ত অন্তত একহাজার গান লিখেছেন তিনি।
টাকার অভাবে লেখা গানগুলো বই আকারে প্রকাশ করতে পারেননি। সেই ধারাবাহিকতায় ২০০৭ সালে বাংলাদেশ বেতারে লোকগানের নিয়মিত শিল্পী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন আর্নিশ মান্দা। কিন্তু পাননি কোনো ভাতা। গারো জনগোষ্ঠীর জন্য নির্মিত ‘সাল গিতাল’ অনুষ্ঠানে প্রথম ‘ও আচিক মান্দিরাং, আফসানংবো নাসিমাং’ শিরোনামের গানটি পরিবেশন করেন। আর্নিশ মান্দার কণ্ঠে ‘ও আচিক মান্দিরাং’ গানটি বেতারে প্রচারের পর ‘ও আচিক মান্দিরাং’ নামে একটি অ্যালবাম প্রকাশের উদ্যোগ নেন প্রয়াত শিল্পী মাইকেল মৃত্যুঞ্জয় রেমা এবং লেখক ও কলামিস্ট সঞ্জীব দ্রং। ২০১১ সালে অ্যালবামটি প্রকাশ করে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম। ২০১২ সালের ওয়ানগালা উৎসবে অ্যালবামটি প্রকাশ পায়। এরপর স্বল্পসময়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে গানটি। ছড়িয়ে পড়ে ইউটিউব-ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
গত এক যুগে গারো জনগোষ্ঠীর কাছে জনপ্রিয়তা পেয়েছে ‘নাচের গান’ হিসেবে। কিন্ত রহস্যজনক কারণে নাচ বা গান পরিবেশনের সময় গানটির শিল্পী হিসেবে আর্নিশ মান্দার নাম উল্লেখ করা হয়নি। কিছু ক্ষেত্রে গানটির শিল্পী হিসেবে অন্য শিল্পীর নাম উল্লেখ করা হয়েছে। তাই গান জনপ্রিয় হলেও শিল্পীর নাম সেভাবে ছড়ায়নি। বরং সময়ের ব্যবধানে হারিয়ে গেছেন লোকচক্ষুর অন্তরালে।
১৯৯৫ সালে ঢাকায় একটি বিদেশি দূতাবাসে কর্মরত স্মৃতি খকসীর সঙ্গে শিল্পী আর্নিশ মান্দার বিয়ে হয়। এরপর স্ত্রী-সন্তান আর গান নিয়ে নব্বইয়ের দশকের শিল্পীর দিনগুলো বেশ ভালোই কেটেছে। ২০১৭ সালে হঠাৎ চাকরি হারিয়ে বেকার হয়ে পড়েন আর্নিশ মান্দা। নির্ভরশীল হয়ে পড়েন স্ত্রীর ওপর। ২০১৯ সালে স্ত্রী স্মৃতি খকসীও প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হয়ে চাকরি ছাড়তে বাধ্য হন। পরিবারের সবাইকে নিয়ে ফিরে আসেন ধোবাউড়ার ধাইরপাড়ায় গ্রামে। এরপর দুর্ভাগ্যের থাবা নিয়ে হাজির হয় মহামারি করোনা। অর্থনৈতিক সংকটে বড় ছেলে এবং মেয়ে পড়াশোনা বন্ধ করে ফের ঢাকা পাড়ি জমাই। পরিবারের বাকি সদস্যদের খরচ বহন করতে শিল্পী আর্নিশ মান্দা দিনমুজুরের শুরু করেন। জীবন যুদ্ধে নেমে বন্ধ হয়ে যায় গান লেখা এবং গাওয়া।
বর্তমানে শিল্পী আর্নিশ মান্দা অসুস্থ স্ত্রী ও পুত্র-কন্যাকে নিয়ে পল্লিকবি জসীম উদ্দীনের কবিতার ‘আসমানি’র মতো দুঃসহ দিনযাপন করছেন। মাথা গোঁজার ঠাঁই ছোট্ট একটি একচালা ঘর। যার বেড়া দেওয়ার সামর্থ্যও নেই শিল্পীর। তবুও ভাগ্যে জোটেনি সরকারের আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর। রহস্যজনক কারণে তিনি সরকারি কোনো সুযোগ-সুবিধা পাননি।
আর্নিশ মান্দার স্ত্রী স্মৃতি খকসী বলেন, মান্দা নিজে গান লিখে নিজেই সুর দিয়ে গান গায়। সবাই তার গান পছন্দ করে, এটা ভালো লাগে। ফেসবুক-ইউটিউবে ‘অনেকে নিজের মতো করে গানটি প্রচার করে কিন্তু তারা শিল্পীর নাম উল্লেখ করে না তখন খুব কষ্ট লাগে। আমি দরিদ্র আমার কেউ খোঁজ নেয় না।
মেয়ে তৃতীয়া খকসি জানায়, আমি স্কুল এবং কলেজে কোন উপবৃত্তি পায়নি। ট্রাইবাল থেকে আমার অন্যান্য বন্ধুরা শিক্ষা বৃত্তি পেলেও আমি পাই না। আমার বাবা গরীব বলে কেউ আমাদের মূল্যায়ন করে না। আমার বাবা শিল্পী এটা আমাদের জন্য গর্বের তবে লোকজন বাবার গানকে স্বীকৃতি দেয় না তখন খুব কষ্ট লাগে। অর্থ সম্পদ চাই না শুধু বাবার পরিচিতি এবং কাজের স্বীকৃতি চাই।
শিল্পী আর্নিশ মান্দা বলেন, আমি এবং স্ত্রী যখন চাকরি করতাম তখন কোন টেনশন ছিল না। নিয়মিত গান এবং কবিতা লিখতাম। স্ত্রীর অসুস্থতা এবং আমার চাকরি হারানোর পর থেকে দুর্ভাগ্য হানা দিয়েছে। হয়েছি পথের ভিখারি!
দারিদ্রের যাতাঁকলে আমি আজ পিষ্ট। চর্চা করতে পারিনি লেখালেখি। বন্ধ গান গাওয়া। যা আমাকে সব সমই পীড়া দেয়। সবচেয়ে বেশি কষ্ট লাগে যখন দেখি আমার গান অন্য জনের নামে চালিয়ে হচ্ছে। ইতোমধ্যে আমি এক হাজার গান লিখেছি। টাকার জন্য বই আকারে প্রকাশ করতে পানি। সরকারি বেসরকারি সহযোগিতা পেলে পুনরায় আগের মতো গান চর্চা করতে চাই।
ট্যাইবাল চেয়ারম্যান এডুওয়ার্ড নাপাক বলেন, আনির্শ মান্দা আমাদের গারো ভাষায় নিজে গান লিখে নিজে গায়। সে গানের মাধ্যমে আমাদের কৃষ্টি কালচার ধরে রাখার চেষ্টা করছে। আমি শুনেছি সে অর্থনৈতিক ভাবে খারাপ অবস্থায় আছে। আমাদের কোন ফান্ড নাই। থাকলে সহযোগিতা করতাম।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নিশাত শারমিন বলেন, শিল্পীর অর্থনৈতিক দৈন্যদশার বিষয়টি অবগত ছিলাম না, সামনে কোন সুযোগ আসলে আমি ওনার জন্য কিছু করার চেষ্টা করব।