ময়মনসিংহ জেলা মাছ চাষে সারা বাংলাদেশে প্রথম। বছরে সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকার মাছ উৎপাদন হয় এ জেলায়।
ত্রিশাল পৌরসভার ভাটিপাড়া এলাকার যুবক হুমায়ূন আহমেদ। আনন্দমোহন কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করা এই তরুণ এখন একজন সফল মৎস্য চাষি। ২০১৯ সালে এক একর পুকুরে শিং মাছ চাষের মাধ্যমে হুমায়ূনের ব্যবসায়িক যাত্রা শুরু হয়। বর্তমানে তার বার্ষিক আয় প্রায় কোটি টাকা।
তিনি খবর সংযোগকে বলেন, ২০১৯ সালে এক একর পুকুরে শিং মাছ চাষের মাধ্যমে হুমায়ূনের ব্যবসায়িক যাত্রা শুরু করেন। প্রথম বছর পরীক্ষামূলকভাবে ৬০ হাজার শিং মাছের পোনা ছেড়ে তিনি সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন। মাত্র ৬ মাসের মধ্যে আড়াই লাখ টাকা খরচ করে তিনি ৫ লাখ টাকার মাছ বিক্রি করেন। প্রথম বছরেই শতভাগ লাভ দেখে তিনি এই পেশায় আরও বেশি মনোযোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
২০২০ সালে পুকুরের আয়তন বাড়িয়ে আবারও শিং মাছ চাষ শুরু করলে ভাইরাসের কারণে তিনি কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হন। কিন্তু এই ক্ষতি তাকে দমাতে পারেনি। বরং তিনি নতুন উদ্যমে মাছ চাষে ফিরে আসেন। তার এই সাহসিক সিদ্ধান্তের ফল পায় ২০২৩ সালে, যখন মাত্র ৪২ শতাংশের একটি পুকুর থেকে তিনি প্রায় ৯০ মণ শিং মাছ বিক্রি করেন। হুমায়ূনের চাষ করা শিং মাছের মান এত ভালো যে প্রতি কেজি ১৫ থেকে ২০টি মাছ হয়। সে বছর শুধু ওই একটি পুকুর থেকেই তার ৩ লাখ টাকা লাভ হয়।
শিং মাছের ভালো ফলাফল পাওয়ার পর হুমায়ূন পাঙ্গাস মাছ চাষের দিকে মনোযোগ দেন। তিনি জানান, পাঙ্গাস মাছ চাষে লাভের পরিমাণ শিং মাছের মতো বেশি না হলেও এতে কোনো ধরনের ঝুঁকি নেই। প্রতি ২-৩ মাস অন্তর পুকুরে প্রাকৃতিক উপায়ে চুন ও লবণ ব্যবহার করলেই মাছ সুস্থ থাকে।
বাজারে প্রস্তুতকৃত মাছের খাবারের দাম বেশি হওয়ায় তিনি স্থানীয় ফিড মিল থেকে নিজস্ব ফর্মুলায় খাবার তৈরি করিয়ে নেন। ভিটামিন ও মিনারেলযুক্ত এই উচ্চমানের খাবার তৈরিতে তার প্রতি কেজিতে খরচ পড়ে ৪০ থেকে ৪৫ টাকা।
হুমায়ূনের মত অনেক তরুণ উদ্যোক্তার হাত ধরে মৎস্য চাষে শীর্ষে উঠে এসেছে ময়মনসিংহ জেলা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশের মধ্যে ময়মনসিংহে সবচেয়ে বেশি মাছ উৎপাদন হচ্ছে। এ জেলা থেকে প্রতিদিন শত শত ট্রাকে রুই, কাতলা, মৃগেল, কালিবাউশ, পাঙাশ, তেলাপিয়া, পাবদা, শিং,গুলশা, মাগুরসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ যাচ্ছে রাজধানীসহ সারাদেশে। আশির দশকের শেষ দিকে শুরু হওয়া রূপালি বিপ্লব পূর্ণতা পায় নব্বই দশকে। এরপর ২০১০ সাল থেকে টানা মাছ চাষে প্রথম ময়মনসিংহ। দেশে মোট উৎপাদনের ১২ শতাংশ মাছ উৎপাদন হয় এ জেলায়।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে ময়মনসিংহ জেলায় মৎস্য উৎপাদনে এক নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন জানান, মাছ চাষীদের মূল্যায়ন করলে উৎপাদন আরো অনেক বাড়ানো যেত। সেক্ষেত্রে আমাদের জিডিপি মাছের উপর ভিত্তি করে আরো অনেক বেড়ে যেত। সেজন্য মৎস্য বিভাগ জনবল আরো বাড়ানো দরকার। সেই সাথে গবেষণাগার, পরীক্ষাগার, হিমাগারসহ আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবস্থা করতে পারলে উৎপাদন আরও কয়েক গুণ বেড়ে যাবে।
জেলা মৎস্য অফিসারের কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর মোট ৪ লাখ ১৮ হাজার ৬৪৫ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদিত হয়েছে। এটি গত বছরের তুলনায় অনেক বেশি। মৎস্য উৎপাদনে ময়মনসিংহ জেলায় প্রথম স্থানে আছে ভালুকা। ভালুকায় ৩ হাজার ৫৯৬ হেক্টর আয়তনের পুকুরে ৮৩ হাজার ৫৫৩ মেট্রিকটন মাছ উৎপাদন হয়।
দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ত্রিশাল উপজেলা। ত্রিশালে ৩ হাজার ৬৮৭ হেক্টর আয়তনের পুকুরে মাছের উৎপাদন হয় ৭২ হাজার ৮৮ মেট্রিক টন। তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে ময়মনসিংহ সদর উপজেলা। ২ হাজার ৫০০ হেক্টর আয়তনের পুকুরে মাছের উৎপাদন হয় বছরে প্রায় ৪০ হাজার মেট্রিক টন।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের জৈষ্ঠ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো.মশিউর রহমান বলেন, মাঠ পর্যায়ের কৃষকদের তারা বিভিন্নভাবে উন্নত উপায়ে মাছ চাষের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। মৎস্য খাবার তৈরির জন্য যে উপাদানগুলো বিদেশ থেকে আনতে হয় সেগুলো অনেক দামি। এগুলো দেশে উৎপাদনের ব্যবস্থা করতে হবে। আর মাছের উৎপাদন বাড়াতে হলে আমাদের দেশের প্রত্যেকটি জলাশয়ের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা দরকার। সেজন্য আমরা বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে উন্নত মানের মৎস্য বীজ ও পোনা সরবরাহ করা হয়।
মাছের আড়তধাররা বলছেন, তাদের আড়তে সব ধরণের মাছ উঠছে। মাছের চাহিদা বেশি থাকায় চাষিরা ভালো দাম পাচ্ছে।
ময়মনসিংহ জেলায় প্রায় ৩ লাখ পুকুর ও খামার রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ১ লাখেরও বেশি পুকুর ও খামারে বাণিজ্যিক উৎপাদন হচ্ছে। সব মিলে মৎস্য চাষি প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার।