উত্ত্যক্তের প্রতিবাদ করায় বাবাকে হত্যা, লাশ রেখে পরীক্ষা দিলেন মেয়ে

১৬ বছরের কিশোরী আলফি। চলতি বছরেই মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) পরীক্ষায় বসেছেন তিনি। এলাকার কিছু বখাটে ছেলে মাঝে মাঝেই তাকে ইভটিজিং করে। বুধবার (১৬ এপ্রিল) তাকে ইভটিজিং করার প্রতিবাদ জানানোর এক পর্যায়ে তার বাবাকে পিটিয়ে হত্যা করে বখাটেরা। পিতার নিথর মরদেহ বাড়িতে রেখেই পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছেন তিনি। আজ বৃহস্পতিবার (১৭ এপ্রিল) নগরীর তালাইমারি এলাকায় এমনই হৃদয়বিদায়ক ঘটনা ঘটেছে।

ভুক্তভোগী রাকিয়া ওরফে আলফি নগরীর অগ্রণী বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রী। তারা বাবা নিহত আকরাম আলী (৪৫) পেশায় একজন বাস চালক। তিনি রাজশাহী জেলা মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সদস্য। ইভটিজিং ও হত্যায় অভিযুক্তরা হলেন, একই এলাকার কালু মিয়ার ছেলে নান্টু ও তার সহযোগীরা।

এ ঘটনায় ভুক্তভোগী ছাত্রীর বড় ভাই ও নিহতের ছেলে ইমাম হাসান অনন্ত বাদী হয়ে নগরীর বোয়ালিয়া থানায় সাতজনের নাম উল্লেখ করে ও অজ্ঞাত আর চার থেকে পাঁচজনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন।

মামলায় আসামিরা হলেন- তালাইমারি শহিদ মিনার এলাকার কালু মিয়ার ছেলে নান্টু (২৮), মৃত রতনের ছেলে মো. বিশাল (২৮), মৃত আবদুস সাত্তারের ছেলে মো. খোকন মিয়া (২৮)। এছাড়া তালাইমারি বাবর আলী রোড এলাকার শাহীনের ছেলে তাসিন হোসেন (২৫), মো. অমি (২৫), জামালের ছেলে মো. নাহিদ (২৫), পিরুর ছেলে মো. শিশির (২০)।

মামলা সূত্রে জানা যায়, রাজশাহী মহানগরীর তালাইমারি শহীদ মিনার এলাকায় আসামিরা হাতে লোহার রড, বাঁশের লাঠি, কাঠের লাকড়ি, ইটের আধলা নিয়ে ভুক্তভোগীর বড় ভাই ইমান হাসানের উপর আক্রমন করে। এসময় নান্টুর হুকুমে অন্য আসামিরা তাকে এলাপাথারিভাবে মারপিট করতে থাকে। প্রাণে বাঁচার তাগিদে চিৎকার করলে বাবা আকরাম বাঁচাতে এগিয়ে আসেন। তার বাবা এগিয়ে আসলে অভিযুক্ত নান্টুর হুকুমে আসামিরা এলাপাথারি লাথি, কিলঘুষি মারতে থাকে। এসময় ইটের আধলা দিয়ে হত্যার উদ্দ্যেশে তার (আকরাম) মাথার পিছনে আঘাত করে। মাথায় গুরুতর জখম হয়। পরে তাকে উদ্ধার করে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

নিহতের স্ত্রী মুক্তি বেগম বলেন, ‘আমার মেয়েকে এলাকার নান্টুসহ কয়েকজন উত্ত্যক্ত করতেন। ঘটনার দিন বিকেলে মেয়ে ও আমাকে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করেছে। মেয়ে বাড়িতে এসে বিষয়গুলো বলে। এরপরে নান্টুর পরিবারে জানানো হয়। এতে নান্টুর পরিবার ক্ষিপ্ত হয়ে ছেলেকে অভিযোগের বিষয় জানায়। তারপরে নান্টুসহ কয়েকজন মিলে আমার ছেলেকে (অনন্ত) ঘটনার দিন রাত আটটার দিকে মারধর করে। এসময় ছেলেকে মারধর করতে দেখে আমার স্বামী এগিয়ে গেলে তাকেও মারপিট করে। তখন তাকে (আকরামকে) ইট দিয়ে মাথায় আঘাত করে আহত করেন তারা। পরে বাবা-ছেলেকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। হাসপাতালে নেওয়ার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক আমার স্বামীকে মৃত ঘোষণা করে। ছেলে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রয়েছে।

তিনি আরও বলেন, মেয়ের এসএসসি পরীক্ষা চলছে। বাবার লাশ রেখে মেয়ে পরীক্ষা দিতে গেল। সারারাত অনেক কান্না করেছে বাবার জন্য। সকালে সে পরীক্ষা দিতে যাবে না। প্রতিবেশি স্বজনরা অনেক বুঝিয়ে তাকে পরীক্ষা দিতে পাঠায়। আমার স্বামীকে যারা হত্যা করেছে; আমার সন্তানদের যারা বাবা হারা করেছে তাদের বিচার চাই।  

বিষয়টি নিয়ে অগ্রণী বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ সাইফুল ইসলাম বলেন, সে ক্লাসের ভালো ছাত্রী। তাদের পরীক্ষা শিরোইল উচ্চ বিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। শুনেছি উত্ত্যক্তের প্রতিবাদ করায় তার বাবাকে মারধর করে মেরে ফেলা হয়েছে। পরীক্ষার্থী আলফির বাবার হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করছি।

নগরীর বোয়ালিয়া থানার ওসি মোস্তাক হোসেন বলেন, ‘বুধবার রাতে তালাইমারী শহীদ মিনারের পাশে উভয় পক্ষের মারামারিতে একজন গুরুতর আহত হয়। পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সে মারা যায়। লাশ ময়নাতদন্তের জন্য রামেক হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়েছে। এই ঘটনায় নিহত ব্যক্তির ছেলে অনন্ত বাদী হয়ে ৭ জনের নাম উল্লেখপূর্বক অজ্ঞাত আরও ৪/৫ জনকে আসামি করে বৃহস্পতিবার সকালে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় এখন পর্যন্ত কেউ গ্রেপ্তার হয়নি। তবে আসামিদের গ্রেপ্তারে পুলিশ মাঠে কাজ করছে।’

এ বিষয়ে রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের মুখপাত্র ও অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন) সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, ‘পূর্ব শত্রুতার জেরে এই ঘটনা ঘটেছে বলে আমরা জানতে পেরেছি। এ ঘটনায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। পুলিশ বিষয়টি তদন্ত করেছে। আসামিদের দ্রুততম সময়ের মধ্যে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।’