বাংলাদেশের প্রথম এবং সর্ববৃহৎ পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প রূপপুরে শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড (এনপিসিবিএল)- এর ১৮ কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এর পাশাপাশি নিরাপত্তার স্বার্থে তাদের প্রকল্প এলাকা ও গ্রিন সিটি বহুতল আবাসিক কমপ্লেক্সে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
এই বহিষ্কারাদেশ এমন এক সময় এলো, যখন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের পারমাণবিক সক্ষমতা এবং প্রকল্প পরিচালনার নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রতি বাড়তি নজর রয়েছে। আন্তর্জাতিক আনবিক শক্তি সংস্থা (IAEA)-র সরাসরি তদারকির অধীনে থাকা প্রকল্পটিতে এই ধরনের ঘটনা প্রকল্পের সুনাম ও ভবিষ্যৎ লাইসেন্স প্রক্রিয়াকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলতে পারে।
চাকরিচ্যুত ১৮ জনের মধ্যে রয়েছেন ডেপুটি সুপারিনটেনডেন্ট, সহকারী ব্যবস্থাপক, উপসহকারী ব্যবস্থাপক ও টেকনিশিয়ানসহ প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োজিত ব্যক্তিরা। বরখাস্তদের মধ্যে আছেন—হাসমত আলী, শহিদুল ইসলাম, আবু রায়হান, রফিকুল হাসান, আয়নাল হোসেন, নাঈম আল সাকিব, আবু সাঈদ, এ কে এম আব্দুল আল আমিন, শাহ ইখতিয়ার আলম, ইব্রাহিম খলিলুল্লাহ, আব্দুল আল নোমান, আসিফ খান, ইমামুল আরেফিন, ইকরাম, রুহুল আমিন, ইসমাইল হোসেন, রুবেল হোসেন এবং ফিরোজ আহমেদ।
তাদের সবাই এনপিসিবিএলের আওতায় রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পে কর্মরত ছিলেন। কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. জাহেদুল হাছান স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে এই সিদ্ধান্ত জানানো হয়।
গত ২৮ এপ্রিল থেকে চাকরির নানাবিধ দাবিতে রূপপুর প্রকল্পে আন্দোলন শুরু করেন কর্মকর্তাদের একটি অংশ। ৬ মে তারা ঈশ্বরদী শহরে সংবাদ সম্মেলন ও মানববন্ধন এবং পরদিন প্রকল্পের অফিসে অবস্থান কর্মসূচি ও বিক্ষোভ করেন। এতে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ শৃঙ্খলা লঙ্ঘনের অভিযোগ তোলে।
বহিষ্কৃত উপসহকারী ব্যবস্থাপক রুবেল হোসেন বলেন, ‘আমরা শুধু আমাদের ন্যায্য দাবিগুলোর পক্ষে কথা বলেছি। এমডির অপসারণসহ স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার দাবিতে সংবাদ সম্মেলন করায় আমাদের বরখাস্ত করা হয়েছে।’
প্রকল্পের নিরাপত্তা শাখার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, রূপপুর একটি আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল স্থাপনা। এখানে আন্দোলন, মিছিল বা বিক্ষোভের সুযোগ নেই। এটা শুধু দায়িত্বজ্ঞানহীনই নয়, বরং দেশের পারমাণবিক সক্ষমতার ওপর আঘাত।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, এনপিসিবিএলের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অন্যান্য সরকারি কোম্পানির তুলনায় উচ্চতর বেতন-ভাতা পান। ৭ম গ্রেডের একজন সিনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার মাসে প্রায় ১,৪২,০০০ টাকা পর্যন্ত পেয়ে থাকেন। এর মধ্যে রয়েছে মূল বেতন, বাড়ি ভাড়া, চিকিৎসা ভাতা, প্রজেক্ট এলাউন্স, স্পেশাল এলাউন্স এবং বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট।
এই উচ্চ বেতন-সুবিধা থাকা সত্ত্বেও আন্দোলনকারীরা আরও বাড়তি ভাতা, পদোন্নতি ও এমডি’র অপসারণসহ নানা দাবি তুলে ধরেন, যা প্রকল্প কর্তৃপক্ষ ‘নীতি-বহির্ভূত এবং উদ্দেশ্যমূলক’ বলেই মনে করছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে নিরাপত্তা সংস্কৃতি (Safety Culture), নিরাপত্তা শৃঙ্খলা এবং আচরণবিধি (Code of Conduct) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর ব্যত্যয় প্রকল্প চালনায় বড় ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
তিনি আরও বলেন, বিশ্বের কোথাও নিউক্লিয়ার প্ল্যান্ট এলাকায় এই ধরনের কর্মসূচির নজির নেই। এটা বন্ধ না হলে প্রকল্পের ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে পড়বে।
প্রকল্পের সাইট ইনচার্জ রুহুল কুদ্দুস বলেন, এ বিষয়ে আমরা নিরাপত্তা সংস্থাকে অবহিত করেছি। তারাও গুরুত্বের সঙ্গে বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছেন।
এনপিসিবিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. জাহেদুল হাছান বলেন, কোম্পানির চাকরিবিধি অনুযায়ীই এ ধরেণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।