তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে গ্রামের সুবিধাবঞ্চিত ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তি শিক্ষায় দক্ষ করে আত্মনির্ভরশীলতার পথে এগিয়ে নিতে রাজশাহীর পবা উপজেলায় নেওয়া হয়েছে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। উপজেলার দর্শনপাড়া ইউনিয়ন পরিষদে স্থাপন করা হয়েছে ‘ইউনিয়ন কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র’, যেখানে শিক্ষার্থীরা নামমাত্র খরচে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজেদের ভবিষ্যৎ গড়ার সুযোগ পাবে।
বুধবার (২ জুলাই) দুপুরে ইউনিয়ন পরিষদ ভবনে এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের উদ্বোধন করেন পবা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আরাফাত আমান আজিজ।
উদ্বোধনী বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘বর্তমান যুগ চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের। এই বিপ্লবের সঙ্গে তাল মেলাতে না পারলে আমরা পিছিয়ে পড়বো। এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটি গ্রামের শিক্ষার্থীদের স্বপ্ন বাস্তবায়নের একটি মঞ্চ। এটি কেবল একটি প্রতিষ্ঠান নয়, বরং গ্রামীণ যুবসমাজের আত্মবিশ্বাসী ও স্বাবলম্বী হওয়ার বাতিঘর।’
উপজেলা প্রশাসন জানায়, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ (টিআর) কর্মসূচির আওতায় কেন্দ্রটি স্থাপন করা হয়েছে। সুসজ্জিত কক্ষে একসঙ্গে ২০ জন শিক্ষার্থী এখানে প্রশিক্ষণ নিতে পারবে।
ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে শুরু করে স্নাতকোত্তর পর্যায়ের যে কোনো শিক্ষার্থী কম্পিউটার বেসিক, অফিস অ্যাপ্লিকেশন, ইন্টারনেট ব্রাউজিং এবং নেটওয়ার্কিংয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিতে পারবে। স্বল্প খরচে প্রশিক্ষণের এই সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় এলাকার দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া পড়েছে।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) প্রকৌশলী আবু বাশির বলেন, ‘দক্ষতার অভাবে সৃষ্ট বেকারত্ব একটি মানবসৃষ্ট দুর্যোগ। আমরা কেবল অবকাঠামো উন্নয়ন নয়, মানবসম্পদ উন্নয়নেও বিশ্বাসী। এলাকার তরুণরা দক্ষ হয়ে উঠলেই প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব।’
দর্শনপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান আজাদ আলী বলেন, ‘উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেও আমাদের অনেক তরুণ-তরুণী বেকার। এই কেন্দ্র তাদের জন্য আশার আলো। এখান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে তারা ফ্রিল্যান্সিং, গ্রাফিক্স ডিজাইন বা ডেটা এন্ট্রির মতো কাজ করে নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে পারবে। আমরা চাই, এই কেন্দ্রটি বেকারত্ব দূর করার একটি মডেল হয়ে উঠুক।’
কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ নিতে আসা রাজশাহী নিউ গভঃ ডিগ্রি কলেজের শিক্ষার্থী সাদিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমি ডিগ্রির ছাত্র হলেও আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে কম্পিউটার শিখতে পারিনি। এখানে কম খরচে সেই সুযোগ পেয়ে আমি আনন্দিত। প্রশিক্ষণ শেষে অনলাইনে কাজ করে স্বাবলম্বী হতে চাই।’
চলতি বছর এসএসসি পরীক্ষার্থী মনিরা খাতুন জানায়, ‘পরীক্ষার পর অবসর সময়টা কাজে লাগাতে এসেছি। কম্পিউটার শিখে পরিবারের পাশে দাঁড়াতে চাই। আমাদের গ্রামে এমন সুযোগ পেয়ে আমরা ভাগ্যবান।’
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ইউনিয়ন পরিষদের একটি কক্ষে সারি সারি কম্পিউটারের সামনে বসে শিক্ষার্থীরা মনোযোগ দিয়ে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। কেন্দ্রের প্রশিক্ষক রুহুল আমিন জানান, ‘প্রথম ব্যাচেই আমরা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অভাবনীয় সাড়া পাচ্ছি। তাদের শেখার আগ্রহ দেখে আমরা অভিভূত। বর্তমানে আমরা তাদের কম্পিউটারের মৌলিক বিষয়গুলো যেমন- অফিস অ্যাপ্লিকেশন ও ইন্টারনেট ব্রাউজিং শেখাচ্ছি। এই ভিত্তি তৈরি হয়ে গেলে আমরা তাদের অনলাইন আউটসোর্সিং, বিশেষ করে ফ্রিল্যান্সিং ও গ্রাফিক্স ডিজাইনের মতো লাভজনক বিষয়গুলোর ওপর বিশেষ প্রশিক্ষণ দেবো। আমাদের লক্ষ্য শুধু সার্টিফিকেট দেওয়া নয়, তাদের বাস্তব কর্মক্ষেত্রের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত করে তোলা।’
এই উদ্যোগটি গ্রামের শিক্ষার্থীদের ঘরে বসেই সম্মানজনক উপার্জনের পথ দেখাবে এবং গ্রামীণ অর্থনীতিতে দক্ষ মানবসম্পদ যোগ্য করে দেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
দর্শনপাড়া ইউনিয়ন বিএনপির আহ্বায়ক ও বাগসইল দাখিল মাদ্রাসার সহকারী শিক্ষক আব্দুস সালাম বলেন, ‘এ ধরনের উদ্যোগ সময়োপযোগী। গ্রামের ছেলে-মেয়েরা যাতে প্রযুক্তি শিক্ষায় পিছিয়ে না থাকে, সেজন্য এ ধরনের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র আরও বেশি করে চালু করা প্রয়োজন। এখান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে তারা শুধু নিজেদের জীবনমান উন্নয়ন করবে না, দেশকেও এগিয়ে নেবে।’
দর্শনপাড়া ইউনিয়ন জামায়াতের নায়েবে আমির রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের এলাকার অনেক শিক্ষার্থী কম্পিউটার শেখার সুযোগ পায় না। এই কেন্দ্র চালুর ফলে গ্রামের ছেলেমেয়েরা প্রযুক্তি শিক্ষায় দক্ষ হবে। এতে তাদের চাকরি ও ফ্রিল্যান্সিংয়ের সুযোগ তৈরি হবে। আমরা শিক্ষকরাও চাই, তারা যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দক্ষ হয়ে উঠুক।’