উত্তরশ্যামপুর আশ্রয়ণ প্রকল্প

পানির দরে বরাদ্দের ঘর বিক্রি, অনেকেই থাকেন না নিজের ঘরে

উত্তরশ্যামপুর আশ্রয়ণ প্রকল্পের অধীনে সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার দেশিগ্রাম ইউনিয়নের বলদীপাড়া গ্রামের বাসিন্দা নাজমা খাতুন একটি ঘর পেয়েছিলেন। তিনি তার নামের বরাদ্দের ঘর উত্তরশ্যামপুর গ্রামের সাগর হোসেন নামের এক ব্যক্তির কাছে পানির দরে বিক্রি করে দিয়েছেন। তিনি দাম পেয়েছেন মাত্র ৩০ হাজার টাকা।  

শুধু নাজমা খাতুন নন, শ্যামপুর আশ্রয়ণ প্রকল্পে সরকারি বরাদ্দের ঘর বিক্রি করে দিয়েছেন আরও অনেকে। তাদের একজন দেওঘর গ্রামের জবেদা খাতুন। তিনি টাগড়া গ্রামের মো.হবু নামের এক ব্যক্তির কাছে ৫০ হাজার টাকায় বিক্রি করেছেন তার বরাদ্দ পাওয়া ঘরটি।

জবেদা খাতুনের প্রতিবেশী রেজিয়া খাতুন উত্তরশ্যামপুর গ্রামের সাইদুর রহমানের কাছে ৩০ হাজার টাকায় তার ঘরটিও বিক্রি করেছেন।

এদিকে আশ্রয়ণ প্রকল্পের সরকারি ঘর বরাদ্দ পাওয়া ব্যক্তি নিজ সন্তান ছাড়া অন্য কারো কাছে তা হস্তান্তর করতে পারবেন না বলে জানিয়েছেন তাড়াশ উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) কার্যালয়ের সার্ভেয়ার আব্দুল মমিন মণ্ডল।

তবে বাস্তবতা হচ্ছে, আশ্রয়ণের ঘর বরাদ্দ পাওয়া ব্যক্তিরা গোপনে নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে লিখে দিয়ে তা বিক্রি করে দিচ্ছেন। এসব স্ট্যাম্পে বিক্রেতাদের টিপসই থাকছে। আশ্রয়ণে বসবাসরত কয়েকজন বাসিন্দা এমন তথ্যই জানিয়েছেন।

শনিবার (৯ আগস্ট) সরেজমিনে ওই আশ্রয়ণ প্রকল্পে গিয়ে দেখা যায়, রেজিয়া খাতুনের বিক্রি করা ঘরে ক্রেতা সাইদুর রহমানের ভাই সাইফুল ইসলাম ব্রয়লার মুরগির খামার করেছেন। বিক্রি হওয়া অপর দুটি ঘরে তালবদ্ধ করে রেখেছেন ক্রেতারা।

শ্যামপুর আশ্রয়ণ প্রকল্পের একাধিক বাসিন্দার কাছ থেকে জানা গেছে, শ্যামপুর আশ্রয়ণ প্রকল্পের মোট গৃহহীনদের জন্য নির্মিত ঘরের সংখ্যা ৩৫টি। ইতোমধ্যে ৩টি বিক্রি হয়েছে।

একই সঙ্গে ঘর পাওয়া হাড়িসোনা গ্রামের জহুরুল ইসলাম, দেশিগ্রামের শারমীন খাতুন, তাড়াশের ছানা ও বুলবুলি খাতুনসহ ১০-১২ জন তাদের বরাদ্দ পাওয়া ঘরে থাকেন না। তাছাড়া তাদের মধ্যে দু-একজন কাজের জন্য ঢাকায় বা অনত্র থাকেন। তবে বেশিরভাগ ঘর পাওয়া বাসিন্দা তাদের আগ থেকেই কোনো এলাকায় ঘরবাড়ি থাকায় পূর্বের বাড়িতেই আছেন। এ কারণে আশ্রায়ণের সরকারি ঘরে তালাবদ্ধ রেখে মালিকানার জানান দিচ্ছেন বা বিক্রির পাঁয়তারা করছেন।

অবশ্য শ্যামপুর আশ্রয়ণ প্রকল্পের সভাপতি হেলাল উদ্দিন সরকার জানান, যারা সরকারি ঘর বিক্রি করেন, তারা আমাদের না জানিয়ে গোপনে করেন। পরে যখন ক্রেতারা বসবাস শুরু করেন, তখন বিক্রির বিষয়টি জানা যায়।

আমার জানামতে, গত ৩/৪ মাসের মধ্যে আমাদের আশ্রয়ণে ৩টি ঘর বিক্রির খবর প্রকাশ পেয়েছে। মূলত তদবির, জনপ্রতিনিধিদের পছন্দের লোকজন বা আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে সামর্থ্যবানরা ঘর পেলেও তারা ঘরে থাকবে না, অথবা বিক্রি করে দেবেন এটাই স্বাভাবিক।

এদিকে উপজেলা ভূমি অফিস সূত্রে জানা যায়, গৃহহীন ও ভূমিহীন পরিবারকে পুনর্বাসনের লক্ষ্যে আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় কয়েকটি ধাপে বিগত সরকারের সময়ে উপজেলার 8টি ইউনিয়ন এলাকায় গৃহহীনদের জন্য নির্মিত আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঘরের সংখা ছিল ৩৫৬টি।

এর মধ্যে দেশিগ্রাম ইউনিয়নের বড়মাঝদক্ষিণা আশ্রয়ণ প্রকল্পের একটি মৌজায় ৪৮টি, শ্যামপুর মৌজায় আশ্রয়ণ প্রকল্পে ৩৫টি, তালম ইউনিয়নের গুল্টা মৌজায় খ্রিষ্টান মিশনারিপাড়ায় ১৩টি, গুল্টা কলেজ পাড়ায় ৬টি ঘর আছে। অন্যগুলো বিভিন্ন ইউনিয়ন এলাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে।

সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, শ্যামপুর আশ্রয়ণ প্রকল্পের মোট ৩ জন ও বড় মাঝদক্ষিণা আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর পাওয়া তেঘরী গ্রামের ফয়েজ আলী ও কর্ণঘোষ গ্রামের আব্দুর রাজ্জাক ১ লাখ টাকা করে মোট ৫ জন তাদের নামের বরাদ্দের ঘর বিক্রি করেছেন।

কিন্তু ঘর বিক্রি প্রসঙ্গে তেঘরী গ্রামের ফয়েজ আলী ও কর্ণঘোষ গ্রামের আব্দুর রাজ্জাকের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করলেও তারা কথা বলতে রাজি হননি।

তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বড়মাঝদক্ষিণা আশ্রয়ণের এক নারী সদস্য জানান, উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় আরও বেশ কয়েকটি আশ্রয়ণের ঘর বিক্রি হয়ে থাকতে পারে। বিষয়টি মিথ্যে নয়। আপনারা খোঁজ নিতে পারেন।

এছাড়া শ্যামপুরে ৮-১০ জন, বড়মাঝদক্ষিণা ৭-৮ জন, গুল্টা কলেজ পাড়ায় আশ্রয়ণ প্রকল্পের ১টি ঘরে গত দেড় বছর যাবৎ বরাদ্দ পাওয়া ১৮-২০টি পরিবার আদৌ বসবাস করেননি। বর্তমানে এসব ঘরে কেউ বসবাস করছে না। এসব ঘরে ঝুলছে তালা।

তবে গুল্টা খ্রিষ্টান মিশনারিপাড়ার আশ্রয়ণ প্রকল্পে ১৩টির মধ্যে ১৩টিতেই পরিবারসহ বসবাস করছেন বরাদ্দ পাওয়ারা। এখনকার কেউ ঘর বিক্রি বা ঘর তালাবদ্ধ রাখেননি।

শ্যামপুরে আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দা মকবুল হোসেন (৭৫) জানান, আমাদের আশ্রয়ণের ৭টি টিউবওয়েলের ৩টি নষ্ট, ড্রেনগুলো রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অকেজো, আশ্রয়ণের ভেতরে ও বাইরে চলাচলের রাস্তা কাদামাটিতে একাকার। কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নেই। এসব কারণেও অনেকে সরকারি ঘর বরাদ্দ পেলেও থাকতে চান না।

অপরদিকে তাড়াশ উপজেলায় আশ্রয়ণ প্রকল্পে বেশি ঘর বরাদ্দ পাওয়া দেশিগ্রাম ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জ্ঞানেন্দ্রনাথ বসাক বলেন, ঘর বিক্রি, ঘরে না থাকা বিষয়গুলো আমাদের অনেকেই জানিয়েছেন। তবে লিখিতভাবে কেউ জানাননি।

এ প্রসঙ্গে তাড়াশ উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) নুসরাত জাহান জানান, ঘর বিক্রির অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সেই সঙ্গে অনান্য বিষয় জেনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।