রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরীতে চাঞ্চল্যকর সগিরা মোর্শেদ খুন হওয়ার ৩০ বছর পর ঘটনার রহস্য উদঘাটন করেছিল পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
সেই হত্যা মামলায় আজ (১৩ মার্চ) দুইজন আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। এছাড়া অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় তিনজনকে খালাস দেওয়া হয়েছে।
ঢাকার ভিকারুননিসা নূন স্কুলের সামনে ১৯৮৯ সালের ২৫শে জুলাই বিকেলে সগিরা মোর্শেদকে গুলি করে হত্যা করা হয়। সেদিন রিকশায় করে যাবার পথে তার অলংকার ছিনতাইয়ের চেষ্টার সময় বাধা পেয়ে তাকে গুলি করেছিল দু'জন লোক ।
এটি ছিনতাই নয়, ছিল পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড । এর পেছনে ছিল পারিবারিক দ্বন্দ্ব। পিবিআইয়ের এক দীর্ঘ তদন্তে বেরিয়ে এসেছিল চাঞ্চল্যকর অনেক তথ্য।
তদন্ত কর্মকর্তারা জানিয়েছেন,পারিবারিক প্রতিহিংসার শিকার হবার কারণেই মিসেস সগিরা মোর্শেদকে হত্যা করা হয়েছিল । আটাশ বছর ধরে ফাইলবন্দি থাকার পর ২০১৯ সালের ২৬ জুন মামলার উপর স্থগিতাদেশ তুলে নিয়েছিল হাইকোর্ট। পরবর্তীতে, অধিকতর তদন্তের জন্য একই বছরের ১১ জুলাই আদালত মামলাটি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন পিবিআইকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। ৬০ দিনের মধ্যে মামলাটির অধিকতর তদন্ত শেষ করতে একইসঙ্গে তদন্ত শেষ হওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে বিচারকাজ শেষ করতে পিবিআইকে নির্দেশ দিয়েছিলেন আদালত।
আদালতের নির্দেশ পাওয়ার পর পিবিআই এর তদন্ত দল পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ থেকে এ মামলার ফাইলটি নিয়ে আসেন। পুরো ঘটনা বিশ্লেষণে তদন্ত কর্মকর্তাদের মনে প্রশ্ন জাগে, ছিনতাইয়ের জন্য প্রকাশ্য দিবালোকে এভাবে কি কোনো খুন হতে পারে?
এরপর ঘটনাস্থল একাধিকবার পরিদর্শন করে এবং খোঁজ খবর নিয়ে তারা জানতে পারেন যে এই এলাকায় বহুবার চুরি ও ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু কখনও কাউকে হত্যা করা হয়নি। বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার একমাত্র উপায় ছিল ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সেই রিকশাচালক আবদুস সালামতে খুঁজে বের করা। যার বয়স বর্তমানে ৫৫ বছর।
মামলার ফাইলে তার ঠিকানা দেয়া ছিল জামালপুর জেলায়। সেটার সূত্র ধরে পুলিশ তার অবস্থান নির্ণয়ের করতে গিয়ে জানতে পারেন যে তিনি বর্তমানে ঢাকায় আছেন। কিন্তু তার কোনো ঠিকানা বা ফোন নম্বর পাওয়া যায়নি।
এরপর পুলিশ টানা কয়েক মাস ভিকারুন্নেসা নূন স্কুলের আশেপাশের রিকশা গ্যারেজগুলোয় প্রবীণ রিকশা চালকদের কাছ থেকে খোঁজ খবর নিতে শুরু করেন। এক পর্যায়ে এক প্রবীণ রিকশা চালক আবদুস সালামের খোঁজ দেন।
তবে তিনি তার কোনো ঠিকানা দিতে পারেননি। আবদুস সালাম প্রতিদিন একটি দোকানে আসেন, পুলিশকে ওই রিকশাচালক সেই দোকানের ফোন নম্বরটি দেন। পরে ওই নম্বরে তদন্ত কর্মকর্তারা যোগাযোগ করলে দোকান কর্মকর্তা জানান আবদুস সালাম তার পাশেই রয়েছে।
পরে ফোনে তার কাছে জানতে চাওয়া হয় এই ১৯৮৯ সালের ঘটনা সম্পর্কে তিনি কিছু জানেন কিনা। আবদুস সালাম বলেন যে তিনি এ বিষয়ে জানেন। পরে তাকে থানায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে রিকশাচালক আবদুস সালাম জানান, ঘটনার দিন বিকেলে ভিকারুন্নেসা স্কুলের কাছে মোটরসাইকেলে করে আসা দুই যুবক তাদের রিকশার পথ আটকে দাঁড়ায়।
ওই দুই যুবক সে সময় দেখতে কেমন ছিলেন তার শারীরিক গড়নের বর্ণনা দেন আবদুস সালাম। যা পরবর্তীতে পুলিশের কাজে লাগে। প্রথমে তারা মিসেস সগিরা মোর্শেদের হাতব্যাগটি ছিনিয়ে নেয় এবং তার পরনে থাকা স্বর্ণের বালা ধরে টানাটানি শুরু করে। এসময় মিসেস সগিরা তাদের একজনকে দেখে বলেন, 'আমি আপনাকে চিনি', এবং তার নামটিও বলেন।
এই কথা বলার পরই অপর যুবক পিস্তল বের করে মিসেস সগিরাকে লক্ষ্য করে দুটি গুলি ছোঁড়েন। এ সময় আশেপাশে লোকজন জড়ো হতে শুরু করলে তারা আরও কয়েকটি ফাঁকা গুলি করে মৌচাকের দিকে পালিয়ে যায়।
রিকশাচালক তাদেরকে তাড়া করলেও রাস্তার কোনো মানুষ অভিযুক্ত দুজনকে থামাতে আসেনি বলে জানান তিনি। এদিকে ঘটনাস্থল অতিক্রম করার সময় এক ব্যক্তি মিসেস সগিরাকে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখতে পেয়ে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
পারিবারিক কলহের জেরে এই হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয়েছে বলে পিবিআইয়ের তদন্তে বেরিয়ে এসেছিল। ঘটনার সূত্রপাত ১৯৮৫ সাল থেকে। নিহতের স্বামী এবং বাদী সালাম চৌধুরী তার তিন ভাইয়ের মধ্য সবার কনিষ্ঠ।
চাকরি সূত্রে নিহতের স্বামী সালাম চৌধুরী তার পরিবারকে নিয়ে ইরাকে থাকলেও ১৯৮৪ সালে ইরাক-ইরান যুদ্ধের কারণে তাদেরকে বাংলাদেশে ফিরে আসতে হয়। তখন থেকে তিনি ঢাকায় রাজারবাগ পেট্রোল পাম্পের পৈত্রিক বাড়িতে বসবাস শুরু করেন।
দোতালা বাসার নীচতলায় বড় ভাই সামসুল আলম চৌধুরীর থাকতেন। ওপরের তলায় থাকতেন সালাম দম্পতি ও তাদের তিন মেয়ে। মেঝ ভাই ডা. হাসান আলী চৌধুরী স্ত্রী-সন্তানসহ লিবিয়ায় থাকলেও ১৯৮৫ সালে তারাও দেশে ফিরে আসেন।
সূত্র: বিবিসি বাংলা