আইসবার্গ—প্রকৃতির এক অদ্ভুত, মহিমান্বিত সৃষ্টি। কিন্তু দুঃখজনক সত্য, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এই বিশাল বরফের টুকরোগুলি দ্রুত গলে যাচ্ছে, যা বিশ্বব্যাপী পরিবেশের জন্য বিপজ্জনক সংকট তৈরি করতে পারে।
সম্প্রতি বিশ্বের সবচেয়ে বড় দ্বীপ গ্রিনল্যান্ডে এমন এক ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছে। সেখানে একটি বিশাল গ্লেসিয়ার বা বরফের পাহাড় হঠাৎ করেই ভেঙে সমুদ্রে পড়েছে। বিজ্ঞানীরা এই ঘটনাকে জলবায়ু পরিবর্তনের একটি ভয়াবহ সতর্কবার্তা বলে মনে করছেন। ন্যাশনাল ওশানিক অ্যান্ড অ্যাটমোসফেরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (NOAA) মতে, ‘বিশ্বব্যাপী, অধিকাংশ গ্লেসিয়ার সংকুচিত বা পুরোপুরি বিলুপ্ত হচ্ছে। গত ৩৭ বছর ধরে প্রতি বছরই গ্লেসিয়ারগুলো ছোট হচ্ছে।’
গ্রিনল্যান্ডের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে একটি বিশাল গ্লেসিয়ার সম্পূর্ণভাবে ভেঙে গেছে। এটি এতটাই বড় ছিল যে এই বরফ গললে যত পানি পাওয়া যেত, তা দিয়ে আমেরিকার পুরো কলোরাডো নদীকে এক বছর পূর্ণ করে রাখা যেত। উষ্ণ সমুদ্রের পানির তাপে গ্লেসিয়ারটির নিচের স্তর দুর্বল হয়ে যাওয়ায় এটি ভেঙে পড়ে।
একটি ভিডিওতে দেখা যায়, কয়েকটি পর্যটন নৌকা গ্লেসিয়ারটি দেখছিল, হঠাৎ বিশাল বরফের টুকরো ধ্বংস হতে শুরু করে এবং পানি থেকে তৈরি হওয়া ঢেউ নৌকাগুলিকে দ্রুত নিরাপদ স্থানে সরে যেতে বাধ্য করে।
ভিডিওটি ধারণকারী গর্ডন ডি বলেন, আমি ঠিক তখনই এই বিস্ময়কর আইসবার্গটি ক্যামেরায় ধারণ করতে শুরু করেছিলাম। এর আকার বোঝা খুবই কঠিন, কিন্তু আমাদের জাহাজের চেয়ে অন্তত চারগুণ বড়—দৈর্ঘ্যে প্রায় ৩০০ মিটার এবং উচ্চতায় প্রায় ৩০ মিটার। হঠাৎ, সেখানে যা ঘটেছিল, তা ছিল কল্পনার বাইরে।’
গর্ডন আরও বলেন, ‘আমরা প্রায় ৩০০ মিটার দূরে ছিলাম। ক্যামেরাটি কাঁপছিল, কারণ সেখান থেকে দ্রুত তাড়াহুড়ো করে নিরাপদ স্থানে যাওয়া চেষ্টা চলছিল।
ধসের কারণে একটি বিশাল ঢেউ তৈরি হয়।ভাগ্যক্রমে, সবাই নিরাপদে পৌঁছায়। আইসবার্গ প্রায় পুরোপুরি উল্টে যায় এবং প্রায় ৮০ শতাংশ অস্তিত্ব হারায়।’
গ্লেসিয়ারের ধসের ঢেউতে সার্ফিং করার চেষ্টা অতীতে সফলভাবে করা হয়েছে। পর্তুগিজ সার্ফার ইউরিকো রোমাগুয়েরা গত বছর গ্রিনল্যান্ডে এমনই কিছু সার্ফিং মুহূর্তের ছবি তুলেছিলেন। ফটোগ্রাফার জর্জে আবিয়ান বলেন, ‘সবকিছু যেন স্ক্রিপ্টেড মনে হচ্ছিল। বরফ গ্লেসিয়ার থেকে পড়তে শুরু করলো এবং আমরা প্রথম সার্ফেবল ঢেউয়ের সাক্ষী হলাম। ইউরিকো সেই ঢেউ ক্যামেরায় ধরলেন এবং আমরা সেই মুহূর্ত ধারণ করতে সক্ষম হলাম।’
ঘটনাটি শুধু এক প্রাকৃতিক বিস্ময় নয়, বরং জলবায়ু পরিবর্তনের চূড়ান্ত প্রভাবকেও সামনে আনছে। বিশাল আইসবার্গের ধস এবং তৈরি হওয়া ঢেউ পর্যটকদের জন্য দারুণ উত্তেজনাপূর্ণ হলেও, এটি আমাদের পৃথিবীর জলবায়ুর সংবেদনশীলতার প্রতি সতর্কবার্তা।
গ্রিনল্যান্ডের বরফ পুরো বিশ্বের সমুদ্রের উচ্চতা নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এরকম বড় আকারের গ্লেসিয়ার ভেঙে পড়ার মানে হলো, সমুদ্রের পানির উচ্চতা দ্রুত বাড়বে। ফলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উপকূলীয় অঞ্চল এবং নিচু দ্বীপগুলো ডুবে যাওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যাবে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই ঘটনা প্রমাণ করছে যে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব আমরা যা ভেবেছিলাম, তার চেয়েও দ্রুত গতিতে ঘটছে। পৃথিবী দ্রুত গরম হয়ে উঠছে, যার ফল দেখা যাচ্ছে মেরু অঞ্চলগুলোতে।
বিজ্ঞানীরা জোর দিয়ে বলছেন, সময় এখনও শেষ হয়ে যায়নি, কিন্তু এখনই সঠিক পদক্ষেপ না নিলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানি খুঁজে বের করা, বন উজাড় বন্ধ করা এবং কার্বন নিঃসরণ কমানোর মতো কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া এখনই অত্যন্ত জরুরি।