নিরাপদ হজ পালনে ডায়াবেটিস রোগীদের করণীয়

প্রতিবছর সারা বিশ্বের লাখ লাখ মুসলমান হজ পালনের জন্য সৌদি আরব যান। তাঁদের মধ্যে অনেকেই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, যা দীর্ঘ যাত্রা, প্রচণ্ড গরম, শারীরিক কষ্ট, অনিয়মিত খাদ্যাভ্যাস ও ঘন জনসমাগমে জটিল আকার ধারণ করতে পারে। ফলে হজের পূর্ণতা লাভ করতে চাইলে ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য আগে থেকেই সুনির্দিষ্ট প্রস্তুতি ও নিয়ম মেনে চলা অত্যন্ত জরুরি।

হজযাত্রার আগে শারীরিক ও মানসিক প্রস্তুতি অপরিহার্য

ডায়াবেটিস রোগীদের হজের প্রতিটি রীতিনীতি পালনে শারীরিক পরিশ্রম বেশি হয়। এজন্য হজের কয়েক মাস আগেই নিয়মিত হাঁটার অভ্যাস গড়ে তোলা প্রয়োজন। প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটার মাধ্যমে শরীর প্রস্তুত করা উচিত। একইসঙ্গে মানসিক প্রস্তুতিও জরুরি, কারণ হজকালীন শারীরিক কষ্ট ও পরিবেশগত বৈচিত্র্য ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য চাপ সৃষ্টি করতে পারে।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে রোগের বর্তমান অবস্থা ও সম্ভাব্য ঝুঁকিগুলো বিশ্লেষণ করে ওষুধ, ইনসুলিন, ইনফেকশন প্রতিরোধের টিকা (মেনিনজাইটিস ও ফ্লু) গ্রহণ করা আবশ্যক। কমপক্ষে ৪৫ দিনের জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধ ও সরঞ্জাম (গ্লুকোমিটার, স্ট্রিপ, ল্যান্সেট, অ্যালকোহল সোয়াব) সংগ্রহ করে নিতে হবে।

হজকালে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে করণীয়

  • হাইপারগ্লাইসেমিয়া (রক্তে সুগার বৃদ্ধি)

অনিয়মিত খাবার, ইনসুলিন ব্যবহার না করা বা অতিরিক্ত খাদ্যগ্রহণের ফলে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে যেতে পারে। এ সময় ঘন ঘন প্রস্রাব, অতিরিক্ত পিপাসা ও দুর্বলতা দেখা দিতে পারে। তাই নিয়মিত গ্লুকোমিটারে সুগার পরীক্ষা ও কিটোন বডি টেস্ট করতে হবে। ইনসুলিনের ডোজ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সামঞ্জস্য করতে হবে।

  • হাইপোগ্লাইসেমিয়া (রক্তে সুগার হ্রাস)

অনিয়মিত খাবার গ্রহণ, অতিরিক্ত হাঁটা কিংবা শারীরিক পরিশ্রমের কারণে হাইপোগ্লাইসেমিয়া দেখা দিতে পারে। ঘাম, মাথা ঝিমঝিম, বুক ধড়ফড় করা এসব লক্ষণ দেখা দিলে তাৎক্ষণিকভাবে গ্লুকোজ, খেজুর, মিষ্টি বিস্কুট বা ফলমূল খেয়ে নিতে হবে এবং ১৫ মিনিট পর সুগার পরীক্ষা করতে হবে। প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। হজের সময় অ্যানালগ ইনসুলিন ব্যবহার করলে হাইপোগ্লাইসেমিয়ার ঝুঁকি কমে।

  •  পানিশূন্যতা

হজের সময় প্রচণ্ড গরম ও ঘামের কারণে দেহে পানিশূন্যতা দেখা দিতে পারে, যা ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য মারাত্মক। প্রতিদিন ২–৩ লিটার পানি, বিশেষত জমজমের পানি পান করার পরামর্শ দেওয়া হয়। অ্যাজমা রোগীদের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ঠান্ডা পানি এড়িয়ে চলা ভালো।

  •  পায়ের যত্ন

ডায়াবেটিস রোগীদের পায়ে ক্ষত, ফোসকা বা সংক্রমণ হতে পারে। আরামদায়ক ও সঠিক মাপের জুতা পরা, প্রতিদিন পা ধুয়ে শুকিয়ে রাখা, ময়েশ্চারাইজার লাগানো এবং রাতে পা পরীক্ষা করা আবশ্যক। পায়ে ক্ষত দেখা দিলে দ্রুত অ্যান্টিবায়োটিক ও চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে।

  •  হিটস্ট্রোক প্রতিরোধ

সৌদি আরবের গরমে হিটস্ট্রোকের ঝুঁকি থেকে রক্ষা পেতে সাদা ছাতা ব্যবহার করুন, সরাসরি রোদে না গিয়ে ছায়ায় থাকুন এবং শরীর ঠান্ডা রাখতে ভেজা কাপড় ব্যবহার করুন। হিটস্ট্রোকের লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসা সেবা নিতে হবে।

  • সংক্রমণ প্রতিরোধ

ভিড় ও জনসমাগমের কারণে ডায়াবেটিস রোগীদের সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি। তাই মাস্ক ব্যবহার, সাবান দিয়ে হাত ধোয়া এবং বিশুদ্ধ খাবার গ্রহণ জরুরি। ডায়রিয়া হলে ওরস্যালাইন খেতে হবে এবং তীব্র লক্ষণ দেখা দিলে নিকটস্থ মেডিকেল সেন্টারে যেতে হবে।

বিশেষ পরামর্শ

  • ইনসুলিন নিলে সেটি হ্যান্ড ব্যাগে রাখুন এবং হোটেলের ফ্রিজে সংরক্ষণ করুন। মিনার মতো এলাকায় ফ্রিজ না থাকায় ইনসুলিন সংরক্ষণের জন্য আলাদা ফ্লাস্ক বা ওয়ালেট ব্যবহার করুন।
  • খাবার পেতে দেরি হতে পারে, তাই খেজুর, বিস্কুট, বাদাম, দুধজাত দ্রব্য ও স্ন্যাকস জাতীয় বিকল্প খাবার সঙ্গে রাখুন। হজ ক্যাম্পে পৌঁছেই নিজের ডায়াবেটিসের কথা জানান এবং প্রয়োজন অনুযায়ী ক্যাম্পের চিকিৎসকদের সহায়তা নিন।

ডায়াবেটিস থাকা মানেই হজ পালনে বাধা নয়। বরং পরিকল্পিত প্রস্তুতি, চিকিৎসকের নির্দেশনা মেনে চলা এবং নিজের প্রতি সচেতনতা থাকলে এই গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত একজন ডায়াবেটিস রোগীর পক্ষেও সুস্থভাবে পালন করা সম্ভব। তাই হজে যাওয়ার আগেই প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য সচেতনতা ও প্রস্তুতি নিয়ে এগিয়ে যাওয়া উচিত যেন মহান আল্লাহর ডাকে সাড়া দেওয়ার এই সফর হয় নিরাপদ, পূর্ণাঙ্গ ও প্রশান্তিময়।