অতিরিক্ত লবণ গ্রহণে বছরে ২৫ হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে

বাংলাদেশে অতিরিক্ত লবণ গ্রহণের ফলে প্রতিবছর প্রায় ২৫ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করছেন— যা জনস্বাস্থ্যের জন্য এক ভয়াবহ ও নীরব সংকেত। উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, স্ট্রোক এবং কিডনি রোগের মতো মারাত্মক অসংক্রামক রোগের মূল সহায়ক এই অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ, যা প্রতিনিয়ত দেশের স্বাস্থ্যখাতে বাড়তি চাপ সৃষ্টি করছে।

জাতীয় প্রেসক্লাবে বুধবার (১৪ মে) ‘বিশ্ব লবণ সচেতনতা সপ্তাহ-২০২৫’ উপলক্ষে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় গবেষণা ভিত্তিক এসব উদ্বেগজনক তথ্য তুলে ধরা হয়। 

সভায় সভাপতিত্ব করেন ফাউন্ডেশনের সভাপতি অধ্যাপক খন্দকার আবদুল আউয়াল রিজভী। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন লবণ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির সমন্বয়ক ডা. আহমাদ খাইনুল আবরার।

গবেষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশের একজন প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিক প্রতিদিন গড়ে ৯ গ্রাম লবণ গ্রহণ করছেন, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) নির্ধারিত মাত্রা ৫ গ্রামের প্রায় দ্বিগুণ। অতিরিক্ত লবণ গ্রহণের সবচেয়ে বড় উৎস হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে প্রক্রিয়াজাত ও প্যাকেটজাত খাবার।

ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের রোগতত্ত্ব ও গবেষণা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী বলেন, লবণ শুধু স্বাদের উপাদান নয়, এটি অতিরিক্ত গ্রহণ করলে নীরবে মানুষের শরীরে জটিল অসংক্রামক রোগ তৈরি করে, যা মৃত্যুর ঝুঁকি বহুগুণ বাড়ায়।

বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সদস্য অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শোয়েব বলেন, দেশের বর্তমান মোড়ক আইন অনুযায়ী খাদ্যপণ্যে লবণ, চিনি ও চর্বির পরিমাণ উল্লেখ বাধ্যতামূলক হলেও বাস্তবে অনেক কোম্পানি তা এড়িয়ে চলে অথবা অস্পষ্টভাবে তা প্রদর্শন করে।

তিনি আরও বলেন, জনগণ যেন সহজেই স্বাস্থ্যঝুঁকিপূর্ণ উপাদান চিহ্নিত করতে পারে, সেজন্য ফ্রন্ট-অফ-প্যাক লেবেলিং বাধ্যতামূলক করা জরুরি।

প্রক্রিয়াজাত খাবারের লবণমাত্রা নিয়ন্ত্রণ ও লেবেলিং-এ স্বচ্ছতা আনার জন্য সরকার ইতোমধ্যেই মোড়কীকরণ আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে বলে সভায় জানানো হয়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক সৈয়দ জাকির হোসেন সভায় বলেন, সরকার এই সমস্যাটি সমাধানে আন্তরিক এবং জাতীয় লবণ গ্রহণ হ্রাস কৌশল প্রণয়নের কাজ ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। এটি দ্রুত বাস্তবায়িত হবে বলে আশা করা যায়।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. শিব্বির আহমেদ ওসমানী বলেন, অনিরাপদ খাদ্যাভ্যাস বদল ছাড়া স্বাস্থ্য সুরক্ষা সম্ভব নয়। সরকারের একক প্রচেষ্টায় নয়, এ ক্ষেত্রে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম ও জনগণের সম্মিলিত অংশগ্রহণ জরুরি।

সভায় অধ্যাপক সোহেল রেজা চৌধুরী জাতীয় পাঠ্যক্রমে লবণের ক্ষতিকর প্রভাব অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করেন, যাতে শিশুদের মধ্যে শৈশব থেকেই স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস গড়ে ওঠে। শিশুদের জন্য এটি হবে একটি দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ।

সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক রিজভী বলেন, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন দীর্ঘদিন ধরে গোপন লবণবিষয়ক সচেতনতা বাড়াতে কাজ করছে। এখন সময় এসেছে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রক্রিয়াজাত খাদ্যে লবণের মাত্রা নির্ধারণ এবং জনসচেতনতায় ব্যাপক প্রচারণা চালানোর।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিনিধি, পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের পরিচালক, এবং অন্যান্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা সভায় উপস্থিত ছিলেন এবং বক্তব্য রাখেন।