বর্তমান বিশ্বে অনেক ধরনের দিবস উদযাপন করা হয়ে থাকে। কিন্তু মশা দিবস যে পালিত হয়, সেটি বেশির ভাগ মানুষেরই অজানা। প্রতিবছর ২০ আগস্ট পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মশা দিবস হিসেবে পালিত হয় দিনটি।
আজ মঙ্গলবার (২০ আগস্ট) বিশ্ব মশা দিবস। দিনটির মূল উদ্দেশ্য হলো মশাবাহিত রোগ সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং মশা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ। ১৮৯৪ সালে ব্রিটিশ ডাক্তার প্যাট্রিক ম্যানসন ও ভারতীয় মেডিক্যাল সার্ভিসের মেডিক্যাল অফিসার রোনাল্ড রস ম্যালেরিয়া প্যারাসাইটের সম্ভাব্য ভেক্টর হিসেবে মশার বিষয়ে গবেষণা শুরু করেন।
বছরের পর বছর নিরলস গবেষণার পর ১৮৯৭ সালে তারা প্রমাণ করেন যে অ্যানোফিলিস মশা ম্যালেরিয়া পরজীবী বহন করতে পারে। পরবর্তীকালে রোনাল্ড রস এই আবিষ্কারের জন্য ‘নোবেল’ পুরস্কার পান। তাঁরা তাঁদের আবিষ্কারের দিন, ২০ আগস্ট ১৮৯৭-কে ‘মশা দিবস’ বলে অভিহিত করেছিলেন। লন্ডন স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিন পরে তাঁদের আবিষ্কারের তাৎপর্য ধরে রাখতে ২০ আগস্ট বিশ্ব মশা দিবসের নামকরণ করেন, যা প্রতিবছর পালিত হয়। এটি শুধু একটি বৈজ্ঞানিক মাইলফলক উদযাপন করার দিন নয়, বরং মশাবাহি রোগ প্রতিরোধ করাই এর মূল উদ্দেশ্য।
২০২৫ সালের বিশ্ব মশা দিবসের প্রতিপাদ্য হল : ‘একটি ন্যায়সঙ্গত বিশ্বের জন্য ম্যালেরিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই ত্বরান্বিত করা।’ এই প্রতিপাদ্যটি ম্যালেরিয়ার মতো মশাবাহিত রোগ প্রতিরোধের জন্য ন্যায়সঙ্গত প্রবেশাধিকার এবং বিশ্বব্যাপী সহযোগিতা বৃদ্ধির ওপর জোর দেয়, বিশেষ করে দুর্বল ও দরিদ্র সম্প্রদায়ের জন্য। ১৯৩০ সাল থেকে প্রতিবছরের ২০ আগস্ট দিবসটি বিশ্ব মশা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে।
বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে মশা দিবস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উষ্ণ আর্দ্রীয় দেশ হিসেবে বাংলাদেশের আবহাওয়া ও জলবায়ু মশা প্রজননের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। মশার ঘনত্ব এবং প্রজাতির বৈচিত্র্য বেশি থাকার কারণে মশাবাহিত রোগের ঝুঁকিও বাংলাদেশে অনেক বেশি। বিজ্ঞানীদের গবেষণা অনুযায়ী বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ১২৬ প্রজাতির মশা শনাক্ত করা হয়েছে, তার মধ্যে বর্তমানে ঢাকায় আমরা পাই ১৪ থেকে ১৬ প্রজাতির মশা।
বাংলাদেশে মশাবাহি রোগগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়া ও জাপানিজ এনকেফালাইটিস।
ঢাকায় প্রথম ডেঙ্গু দেখা দেয় ১৯৬৩ সালে। তখন এটিকে ঢাকা ফিভার হিসেবে চিহ্নিত করা বা নাম দেওয়া হয়েছিল। ডেঙ্গুর প্রথম বড় আউটব্রেক হয় ২০০০ সালে আর তখন বিজ্ঞানীরা একে ডেঙ্গু হিসেবে চিহ্নিত করেন। ওই বছর বাংলাদেশে পাঁচ হাজার ৫৫১ জন মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয় এবং ৯৩ জন মারা যায়। এরপর প্রায় প্রতিবছরই কমবেশি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে, তবে ২০১৯ সালে ডেঙ্গু এপিডেমিক আকার ধারণ করে। ওই বছর সরকারি হিসাব অনুযায়ী এক লাখ এক হাজার ৩৫৪ জন মানুষ ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয় এবং দুর্ভাগ্যজনকভাবে ১৭৯ জন মারা যায়।
মশাবাহিত একটি দুর্বিষহ রোগ ফাইলেরিয়া। স্থানীয়ভাবে এই রোগটিকে গোদরোগ বলা হয়ে থাকে। ফাইলেরিয়া রোগে মানুষের হাত-পা ও অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অস্বাভাবিকভাবে ফুলে ওঠে। ফাইলেরিয়া বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম-দক্ষিণের প্রায় ৩৪টি জেলায় কমবেশি পাওয়া যায়। একসময় এ রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি ছিল, তবে বর্তমানে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ফাইলেরিয়া এলিমিনেশন প্রগ্রামের মাধ্যমে এটিকে নিয়ন্ত্রিত পর্যায়ে নিয়ে আসা হয়েছে। ফাইলেরিয়া নেমাটোড-জাতীয় কৃমি; এটি ইউচেরিয়া ব্যানক্রফটিবাহি মশা দ্বারা সংক্রমিত হয়। কিউলেক্স মশার দুটি প্রজাতি ও ম্যানসোনিয়া মশার একটি প্রজাতির মাধ্যমে বাংলাদেশে এ রোগ ছড়ায়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) অনুযায়ী, প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে লাখ লাখ মানুষ মশাবাহিত রোগ যেমন ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, জিকা ভাইরাস ইত্যাদিতে আক্রান্ত হন। বিশেষ করে বাংলাদেশে বর্ষা মৌসুমে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে যায়, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় হুমকি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, মশা দমন করতে হলে শুধুমাত্র প্রশাসনিক পদক্ষেপ নয়, প্রতিটি নাগরিককেও হতে হবে সচেতন। জমে থাকা পানি পরিষ্কার রাখা, মশারি ব্যবহার, বাড়ির চারপাশ পরিচ্ছন্ন রাখা এবং যথাসময়ে চিকিৎসা নেওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।