ভাষাকে বাজিয়ে দিতে পারার মহৎপ্রাণের শিল্পিত কর্ম মঈনুল হাসানের কথাসাহিত্য। উপমা কিংবা ঠেস কথার মাধুর্যের টিউনিংয়ে কবিতার মতো বলে হেলা করার জো নেই বরং তার কথাসাহিত্য আলাদাভাবে দাঁড়িয়ে যায় বুক সটান করে; মঈনুল হাসানের কথাসাহিত্যে নতুনতর শব্দ-যোগে তাৎপর্যপূর্ণ দ্যোতনা সৃজন তদুপরি মার্জিত উপমার শরীরে টান টান রহস্য প্রোথিত; এখনকার কথাসাহিত্যকে প্রতিনিধিত্ব করে।
'শূন্য রথের ঘোড়া' উপন্যাসের পাঠে এইসব সত্যির মুখোমুখি হয়ে মঈনুল হাসানকে মার্কিং করে বাংলা সাহিত্যে বৈভবশালী বৈঠকের উপস্থাপনার দাবি রাখে; 'শূন্য রথের ঘোড়া' উপন্যাসটি পড়ার মধ্যে মঈনুল হাসানের কথাসাহিত্যের দম বুঝতে সক্ষম হবেন। কেননা মঈনুল হাসানের কথাসাহিত্যের বয়ন কৌশল বিষয় আঙ্গিকের অতল স্পর্শে—বহুবিধ স্পর্শ জাগানিয়া প্রবণতায় বৃহৎ কলেবর সুসংগঠিত করতে পারে; একটা ঘটনা বোঝাতে গিয়ে পারিপার্শ্বিক অবস্থার মধ্যে আরও অনেক ঘটনার বর্ণনা এক পরিবেশের সঙ্গে অনেক পরিবেশের সম্মিলন। এইসব বর্ণনা হয়তো বেশি ঝুঁকির কেননা খেই হারিয়ে ফেলার সম্ভাবনা। কিন্তু মঈনুল হাসান এইসব ঝুঁকি বেশ উপভোগ করে লিখতে পারেন। এজন্যই মঈনুল হাসান জাত কথাশিল্পী। এদিকে, মঈনুল হাসানের কথাসাহিত্যের যে বহর এমন সুবিশালে সুবিন্যস্ত, সেখানে পাঠকের কাছে সু-ধীর ভেদবুদ্ধি চেয়ে নিতে পারে, নয়তো রসহীন মনে হতে পারে ঢুকতেই! আদতে মঈনুল হাসানের কথাসাহিত্যের দাপট কিংবা নিজস্ব জগতে তিনি অবিচল এবং দক্ষ কারিগর।
০২.
মঈনুল হাসানের কথাসাহিত্যকে আলাদাভাবে উল্লেখের বিষয় যে, প্রকাশভঙ্গির বৈচিত্র সিনেমাটিক রোল প্লে করে; দৃশ্য থেকে দৃশ্যের যে স্তর, মনে হয় একটা কালজয়ী সিনেমার দৃশ্যবন্দি 'শূন্য রথের ঘোড়া' উপন্যাসটি। মঈনুল হাসানের ভাষার দক্ষতার চেয়ে বলতে হয় উপন্যাস লেখার মধ্যে যে শ্রম সাধ্যের সাধিত চাওয়া সেটি তুলে ধরে। মঈনুল হাসানের মধ্যে এখনকার মতোন খামখেয়ালি কিংবা দেখিয়ে দেওয়ার হাপিত্যেশ, সহজভাবে বললে শর্টকাট পদ্ধতিতে জনপ্রিয়তার মোহ পাবেন না। একজন বড় লেখক হওয়ার সমূহ খাসলত মঈনুল হাসানের লেখার মধ্যে পাবেন এটিই সুখবর; 'শূন্য রথের ঘোড়া' উপন্যাসটি আমার কাছে বিশেষ হওয়ার কারণ, বেশ বড়সড় পরিসরের উপন্যাস হওয়া সত্বেও আমার মধ্যে কোনো বিরক্তিকর ভাব জাগেনি। আমি বাক্য থেকে বাক্যে শুধু নয় শব্দের খেলাও উপভোগ করেছি। হালআমলে উপন্যাসের নামে কয়েক পাতা পড়তেই হাঁপিয়ে উঠি, হয়তো মুখের খাতিরে কয়েক লাইনের অভিমতও রাখি। কিন্তু মঈনুল হাসানের 'শূন্য রথের ঘোড়া' উপন্যাসটি এখনকার বাংলা সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য ঘটনা বটে। উপন্যাসটি বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী মেহেরপুর জেলার সীমান্ত এলাকা ও মানুষজনদের নিয়ে বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহের ঠিকঠাক উপস্থাপন। সহজাত উপমার সারল্যে তরতাজা প্রাণের আকুতি পুরো উপন্যাসে। আমিও যেন এই উপন্যাসের প্রতিটা চরিত্রের সঙ্গে মেহেরপুরের সীমান্তে সরল মনে জড়িয়ে পড়েছি।
০৩.
এই উপন্যাসে কিছু বিশেষ্যের বিশেষণ কিংবা বিশেষণের বিশেষ্য, নতুন শব্দ-বন্ধন আমাকে চমকিত করে। কয়েকটি শব্দ তন্মধ্যে রুখো (শুষ্ক, অনেকে মনে করবে রুখে দাঁড়ানো), ধূপ (সাদা) বকের ডাক, ভুকপিয়াস (ক্ষুধা-তৃষ্ণা), চোখসহা (চোখের সহ্য হওয়া), বাতলি (মনে করিয়ে দেওয়া), ছায়াদানি (ছায়া দেওয়া), সূ্য্যি (সূর্য), রেডিয়োর অঁকবক, গান ভাজতে ভাজতে, ঝিনুকরূপী মানুষ' এইসব বিশেষভাবে প্রভাবিত করে এই উপন্যাসের বিষয়কে। মঈনুল হাসানের এই উপন্যাসে মেহেরপুর জেলার ভাষাকে যেমন আপন লেগেছে তদুপরি সীমান্তলাগোয়া মানুষের কথা আর আচরণের সঙ্গে প্রকৃতি পরিবেশ আমার হৃদয়ে গেঁথে গেছে। হয়তো একজন জাত কথাশিল্পীর এটাই নমুনা।