পল্লীকবি হিসেবে খ্যাত জসীম উদ্দীনের ১২৩ তম জন্মবার্ষিকী আজ। বাংলার শ্যামল প্রকৃতি, গ্রামের মানুষের সহজ-সরল জীবনযাপন আর সোঁদা মাটির ঘ্রাণের অকৃত্রিম জীবনগাঁথাকে তিনি নিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তার সাহিত্য রচনায়।
একারণে আধুনিক বাংলা সাহিত্যের এই শক্তিমান কবি ‘পল্লীকবি’র অমর মর্যাদায় ভূষিত হয়েছেন। তিনি বাংলা কবিতা ও পল্লী গানের অন্যতম প্রাণপুরুষ।
১৯০৩ সালে মতান্তরে ১৯০৪ সালের ১ জানুয়ারি ফরিদপুর সদর উপজেলার তাম্বুলখানা গ্রামে মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা আনসারউদ্দিন মোল্যা একজন স্কুল শিক্ষক ছিলেন এবং মায়ের নাম আমিনা খাতুন। তার পৈত্রিক বসতভিটা ফরিদপুরের শহরের অম্বিকাপুর ইউনিয়নের গোবিন্দপুর গ্রামে অবস্থিত।
সাহিত্যবিশারদদের মতে, কবি জসীম উদ্দীনের আবহমান বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে লালিত প্রথম পূর্ণাঙ্গ আধুনিক কবি। ঐতিহ্যবাহী বাংলা কবিতার মূল ধারাটিকে নগরসভায় নিয়ে আসার কৃতিত্ব তারই। তার ‘নকশী কাঁথার মাঠ’ ও ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ বাংলা ভাষার গীতিময় কবিতার অন্যতম উৎকৃষ্ট নিদর্শন। তার কবিতা বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
১৯৫৮ সালে পাকিস্তান সরকার সাহিত্য ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ কবি জসীম উদ্দীনকে ‘প্রেসিডেন্টস অ্যাওয়ার্ড ফর প্রাইড অব পারফরমেন্স’ প্রদান করে।
১৯৭৪ সালে তাকে বাংলা অ্যাকাডেমি সাহিত্য পুরস্কারের জন্য মনোনীত করা হলেও পুরস্কার প্রদানের ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতা বজায় রাখা হয় না বলে তিনি সেটি প্রত্যাখ্যান করেন। প্রত্যাখ্যান পত্রে কবি উল্লেখ করেছিলেন যে, তিনি আমৃত্যু বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সেবায় নিয়োজিত থাকতে চান, কিন্তু কোনো পুরস্কার বা পদক গ্রহণের জন্য তিনি প্রস্তুত নন।
পরবর্তীতে ১৯৭৬ সালে তাকে রাষ্ট্রীয় সম্মান একুশে পদক এবং ১৯৭৮ সালে তাকে মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কার প্রদান করা হয়।
২০১৯ সাল থেকে বাংলা একাডেমি তার নামে কবি জসীম উদদীন সাহিত্য পুরস্কার প্রবর্তন করে।
১৯৭৬ সালের ১৪ মার্চ ৭৩ বছর বয়সে রাজধানী ঢাকার ধানমন্ডিতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। কবির শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তাকে তার জন্মভূমি ফরিদপুর জেলার অম্বিকাপুর ইউনিয়নের গোবিন্দপুর গ্রামে কবির বাড়ির আঙিনায় অবস্থিত পারিবারিক কবরস্থানে ডালিম তলায় দাফন করা হয়। তার কালজয়ী কবিতা ‘কবর’-এর স্মৃতিবাহী ডালিম তলা বর্তমানে একটি পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। প্রতিদিন দূর দূরান্ত থেকে অনেকে কবির বাড়ি তার পারিবারিক কবর পরিদর্শন করতে আসেন।
২০০৬ সালে কবি স্ত্রী বেগম মমতাজ জসীম উদ্দীনের কবির উদ্দীন মৃত্যুবরণ করেন। এই দস্পতির ঘরে তিন ছেলে ও ২ মেয়ের জন্ম হয়। তাদের বড় ছেলে কামাল আনোয়ার হাসু ১৯৯০ সালের ৩ জুন মৃত্যুবরণ করেন। মেজ ছেলে ড. জামাল আনোয়ার একজন ভূবিজ্ঞানী এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন।
২০২৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তার ছোট ছেলে খুরশীদ আনোয়ার।
এছাড়া বড় মেয়ে বেগম হাসনা মওদুদ একজন পরিবেশবিদ এবং লেখক। তার স্বামী ছিলেন বাংলাদেশের প্রয়াত প্রবীণ রাজনীতিবিদ ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। ছোট মেয়ে আসমা ইলাহী। তার স্বামী ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী (বীর বিক্রম) সাবেক জ্বালানি উপদেষ্টা ছিলেন।
স্মৃতি সংরক্ষণ
প্রতি বছর কবির মৃত্যুবার্ষিকীতে তার সমাধিস্থলে দোয়া মাহফিল ও আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। এছাড়াও তার পৈতৃক বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত জসীম উদদীন জাদুঘর তার ব্যবহৃত জিনিসপত্র ও স্মৃতি বহন করছে।
কবির স্মৃতি সংরক্ষণে তার বাড়ির অদূরে অম্বিকাপুরে গণপূর্ত অধিদফতরের অধীনে ও বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের অর্থায়নে ১১ কোটি ২৫ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রায় ৪ একর জমিতে নির্মাণ করা হয়েছে ‘পল্লীকবি জসীম উদদীন সংগ্রহশালা’।
কর্মসূচি
কবি জসীম উদদীনের ১২৩তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে জেলা প্রশাসন ও জসীম পরিষদের উদ্যোগে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। সকালে পুষ্পমাল্য অর্পণ ও কবর জিয়ারতের পর আলোচনা সভা ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে। এছাড়া কবিতা পাঠের আসরের আয়োজন করা হয়েছে।
নববর্ষ শুধু উৎসব নয়, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও চেতনার প্রতিচ্ছবি