জলধি ‘সম্পাদকের কথা, সম্পাদকের ব্যথা’ সংখ্যা ॥ জাহাঙ্গীর হোসাইন 

‘সম্পাদকের কথা, সম্পাদকের ব্যথা’ অভূতপূর্ব শ্রুতি। শ্রুতি মধুরতা, না কি বিধুরতা, তা বলা মুশকিল। তবে শ্রুতি কটু নয়, এটা নির্দ্বিধায় বলা যায়। মধুরতা বা বিধুরতা থাকুক বা না থাকুক, তবে কিছু একটা তো আছেই, থাকবেই, থাকতে হবেই। সম্পাদকের কথাকে ব্যথায় রূপদানের জন্যই কী এই আয়োজন, না কি সম্পাদকের ব্যথাকে সম্পাদকের হৃদয় হতে নিংড়ে নিয়ে মলাটবন্দি করার ফন্দি এঁটেছেন ‘জলধি’র সম্পাদক নাহিদা আশরাফী, সেটিও বিবেচ্য বিষয়। তিনি সম্পাদকের হৃদয়ের ভার লাঘব করার জন্য এই উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন না কি নিজের অন্তরের ব্যথাকে অন্যের অন্তরে গেঁথে দেওয়ার কৌশল গ্রহণ করেছেন, তাও আলোচনার দাবি রাখে। 

নাহিদা আশরাফী কোন মন্ত্রবলে ‘সকলের গহিন হৃদয়ের ব্যথা’ নিংড়ে বের করেছেন। আমার মনে হয় সম্পাদকরা অত্যন্ত সহজ করে প্রত্যেক স্ব স্ব ব্যথার সর্বস্ব দেবী দুর্গার মতো জলধিতে বিসর্জন দিয়েছেন। তারা জলধিতে ব্যথা বিসর্জনে কোনো প্রকার কার্পণ্য করেছেন কি না, কে জানে। যদি কোনো রকম কার্পণ্য করে থাকেন, তবে তা সম্পাদকের ব্যথার ব্যর্থতা। আর যদি কোনো রকম কার্পণ্য না করে থাকেন, তবে তা একান্ত সম্পাদকের কথা, সম্পাদকের ব্যথা সংখ্যার সর্বোচ্চতম সফলতা।

আমার মনে হয় কেউ কোনো রকম কার্পণ্য করেননি। সবাই উন্নততম উদারতার সঙ্গে সাবলীল চিত্তে নিজেদের ব্যথাটুকু জলধিতে বিসর্জন করেছেন। প্রত্যেকেই ব্যথার বর্ণনা করেছেন ঝরঝরে মুক্তোর মতো শব্দ ও বাক্য বিন্যাসের মাধ্যমে। এতটা সুন্দর এতটা নান্দনিক এতটা মোহনীয়ভাবে যে ব্যথার বর্ণনা করা যায়, তা জানতাম না। এত এত গুণী সম্পাদক, যারা সম্মান সমীহ প্রদশর্ন প্রাপ্ত তাদের এই সমাজের একটা শ্রেণি কতটা অসম্মান প্রদর্শন করেছে, কথাবার্তায় আচার-আচরণে, তারই প্রকাশ রয়েছে জলধির এই সংখ্যায়। 

একজন সম্পাদকের কাছে লিখেছেন, তার এক আত্মীয় মধ্যরাতে তাকে বাসা থেকে বের করে দিয়েছেন তিনি সারারাত ফুটপাতে কাটিয়েছেন। ভেবে দেখুন কতটা অমানবিক।

অর্থের অভাবে স্ত্রীর হাতে ব্রেসলেট বিক্রি করে ছোটকাগজ প্রকাশ করেছেন। আরেকজন সম্পাদক ৫০-১০০টাকার বিজ্ঞাপনের জন্য ধারে ধারে ঘুরে অপমানিত হয়েছেন। সম্পদকের মেধা শ্রমে তিলে তিলে গড়া পাঠাগারটি জ্বালিয়ে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। 

সম্পাদকের দলীয় পরিচয় জানার পরে মোবাইলফোন ফেসবুকসহ সব যোগাযোগ মাধ্যম ব্লক করেছেন। অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা। দল আর ধর্মের জন্যই কী আমরা আমাদের সংস্কৃতি, জাতীয়তাবাদকে বিসর্জন দেবো? লেখকের কাছ থেকে লেখা চাইতে চাইতেও ক্লান্ত হয়ে পড়েন।

বইমেলায় বড় বড় প্রকাশকদের সঙ্গে লিটলম্যাগের স্টল দেখে অনেক তাচ্ছিল্যের সুরে বলে ফেলেন, ‘লিটলম্যাগগুলো কে পড়ে?’ একজন সম্পাদক দুঃখ করে বলেছেন, ‘যোগ্য সম্পাদকের অভাবে বাংলাদেশে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশ খর্বকায় হয়ে আছে।’ অনেক বাধা বিপত্তি ঝড় ঝঞ্জা উপেক্ষা করে কাজ করে যাচ্ছেন আমাদের সম্পাদকরা।

একজন সম্পাদক ছাত্রজীবনে পত্রিকা বের করে দেয়ালে সেঁটেছেন। দুদিন পরে এসে দেখেন পত্রিকা নেই। পত্রিকার স্থানে কে যেন একটি কাগজ সেঁটে রেখেছে। কাগজে লেখা ছিল,‘আমার কবিতা ছাপিসনি কেন? পত্রিকা নিয়ে গেলাম।’

পত্রিকা প্রকাশ করার কারণে একজন সম্পদককে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে। এর চেয়ে ব্যথা আর কী হতে পারে!

বাবার মৃত্যুর পরে মেট্রিক পাস শেষে কামলা দিয়ে ক্ষুদ্র ব্যবসা করে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি পত্রিকা প্রকাশ করছেন একজন সম্পাদক। তাকে শ্রদ্ধা। লেখা জমা দেবে প্রতিশ্রুতি দিয়েও লেখা জমা দেননি। শুধু সম্মানি দিতে অপারগতা প্রকাশ করার জন্য।

একজন সম্পাদকের ভাষ্য হলো, ‘উঁচুদরের পাঠক না পাওয়া।’ আরেকজন কবি আল মাহমুদ সংখ্যার জন্য লেখা চাইতে গিয়ে হেনস্তার শিকার হয়েছেন।

‘কতটুকু পাপ করলে লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদক হতে হয়’ এই শিরোনামে একজন সম্পাদক জলধিতে তার ব্যথা বিসর্জন করেছেন।

একজন সম্পাদক অত্যন্ত আক্ষেপ করে বলেছেন, ‘আজকাল সম্পদকরা, লেখক/কবিকে মুখ্য করে। লেখাকে নয়।’ মায়ের নামে ছোট কাগজ বের করেও মায়ের বকুনি খেতে হয়েছে। কারণ পূজার খরচের বারো আনাই ছোট কাগজ প্রকাশে ব্যয় করে ফেলেছেন। অনেক সম্পাদক দুঃখ করে বলেছেন, ‘ছোট কাগজে সম্পাদকমণ্ডলী থাকে। তবে তাদের কোনো ভূমিকা নেই।’

একজন সম্পাদক বইয়ের আলোচনা সংখ্যা করার পর কবি সেই আলোচনা নিতে না পরে সম্পদককে কদর্য ভাষায় চিঠি লিখেছেন।  অন্য একজন সম্পাদক লিখেছেন, ‘অনেক সময় অগ্রজরা এমন অনেক লেখা গছিয়ে দেন যা হয়তো সম্পাদকের ভাবনায় গুণগত মানের নয়। বয়সে ছোট হয়ে সম্পাদককে ছাপতে হয়।’

আরেকজন পত্রিকা প্রকাশের প্রয়োজনীয় টাকা না থাকায় পিতৃদত্ত ঘড়ি বন্ধক রেখে পত্রিকা প্রকাশ করেছেন।

অন্য আরেকজন পত্রিকা প্রকাশ করার জন্য সহপাঠীর ব্যাগ থেকে টাকা চুরি করেছেন।

অনেকর ব্যথা নেই আছে কথা। আছে আনন্দের স্মৃতি। একজন গুণী সম্পাদককের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে জানা গেলো বাংলা অ্যাকাডেমিতে লিটল ম্যাগাজিনের স্টল প্রাপ্তির ইতিহাস। তিনি ও তার দল অনেকটা জোর করেই ১৯৮৭ সালে লিটল ম্যাগাজিনের স্টল নিয়েছেন। অন্য আরেকজন সাক্ষাৎকারে তার দুঃখ এভাবে ব্যক্ত করেছেন, ‘মুশকিল হয় যখন সংকলন করা হয়, রীতিমতো যুদ্ধ। কবিদের নিয়ে দুটো কাগজ করেছি, মনে হয় পানি পথের যুদ্ধ করার অভিজ্ঞতা। এমন হয়েছে আমাকে খুন করে ফেলবে।’ অনেক সম্পাদক অনেক ধরনের পরামর্শও প্রদান করেছেন।

‘সম্পাদকের কথা, সম্পাদকের ব্যথা’ সংখ্যায় দুই বাংলা মিলিয়ে ৩৬ জন সম্পাদক ও চারজন লেখকের লেখা ও সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে। যাদের কথা ও ব্যথা ছাপা হয়েছে তাদের নাম নিচে তুলে ধরা হলো : ‘ঈক্ষণ’ ও ‘সাম্প্রতিক’ সম্পাদক আমিরুল বাসার, ‘ভাটিয়াল’ সম্পাদক আলমগীর মাসুদ, ‘সূনৃত’ সম্পাদক আহমদ সায়েম, ‘মগ্নপাঠ’ সম্পাদক আহমেদ শিপলু, ‘পেঁচা’ সম্পাদক ইচক দুয়েন্দে, ‘সুচক্ররেখা’ সম্পাদক ইলিয়াস বাবর, ‘লিরিক’ সম্পাদক এজাজ ইউসুফী, ‘বঙ্গসভা’ সম্পাদক এহসান হায়দার, ‘মৃদঙ্গ’ সম্পাদক কামরুল বাহার আরিফ, ‘দ্রষ্টব্য’ সম্পাদক চন্দনকৃষ্ণ পাল, ‘ভাস্কর’ সম্পাদক পুলিন রায়, ‘ঋতি’ সম্পাদক ফজলুর রহমান বাবুল, ‘নিহারণ’ সম্পাদক বঙ্গ রাখাল, ‘কঙ্কাল’ সম্পাদক মনজুর কাদের, ‘আড্ডাপত্র’ সম্পাদক মনসুর আজিজ, ‘খড়িমাটি’ সম্পাদক মনিরুল মনির, ‘ব্যাটিংজোন’ সম্পাদক মাহফুজ রিপন, ‘অরণী’ সম্পাদক মাহমুদ কামাল, ‘দেয়াঙ’ সম্পাদক মাহমুদ নোমান, ‘সাগরকন্যা’ সম্পাদক মোস্তফা হায়দার, ‘প্রকাশ’ সম্পাদক শফিক হাসান, ‘একান্নবর্তী’ সম্পাদক শেলী সেনগুপ্তা, ‘জীবনানন্দ’ সম্পাদক হেনরী স্বপন, ‘শৈলী’ সম্পাদক অমলেন্দু চক্রবর্তী, ‘ইসক্রা’ সম্পাদক অলোক মুখোপাধ্যায়, ‘বহুস্বর’ সম্পাদক চন্দন ঘোষ, ‘সাহিত্য অঙ্গন’ সম্পাদক জয়গোপাল মন্ডল, ‘সুইনহো স্ট্রিট’ সম্পাদক তাপস রায়, ‘ছাপাখানার গলি’ সম্পাদক দেবাশিস সাহা, ‘যাপনচিত্র’ সম্পাদক প্রবাল কুমার বসু, ‘কোরক’ সম্পাদক বিশ্বজিত ঘোষাল ও ‘জমিন’ সম্পাদক রাজকুমার শেখ।

প্রবন্ধ লিখেছেন এইচ এম সিরাজ ও জাহেদ সরওয়ার। সাক্ষাৎকার দিয়েছেন চর্যাপদ সম্পাদক আযাদ নোমান, ভিন্নচোখ সম্পাদক আলী আফজাল খান, শিরদাঁড়া সম্পাদক আহমেদ নকীব, ‘প্রতিশিল্প’ সম্পাদক মারুফুল আলম, সেলিম মোরশেদ ও সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ।

অসাধারণ অভূতপূর্ব একটি কাজ! সম্পাদকদের নিয়ে এমন একটি কাজ দুই বাংলায় সম্ভবত এটিই প্রথম। ‘সম্পদকের কথা সম্পদকের ব্যথা’ যারা এ সংখ্যায় লিখেছেন, তাদের কথার প্রতি সম্মান আর ব্যথার প্রতি সমবেদনা জানাই।