॥ পর্ব-৯ ॥
হঠাৎ করে যেন সবকিছু কেমন মলিন হয়ে গেলো। হাসতে ভুলে গেছে প্রত্যেকে। সোনালী, কাবেরী এখন অনেক কিছু বুঝতে পারে। বাবা মায়ের কষ্ট দেখে যেন খুব তাড়াতাড়ি বড় হয়ে গেছে ওরা। বয়সের তুলনায় ওদের আচরণ তাই বড্ড বুকে লাগে সত্য নারায়ণের। এই বয়সের মেয়েরা হেসে খেলে বেড়ায়, কত আবদার, কত অভিমান করে। অথচ সত্য নারায়ণের মেয়েরা সেখানে বলতে শিখেছে ‘আমাদের কিছু লাগবে না বাবা।’ মেয়েদের মলিন পোশাকের দিকে তাকিয়ে এক বুক হাহাকার জাগে সত্য নারায়ণের। চোখ নামিয়ে নেয় দ্রুত। নিজেকে লুকাতে পারতো যদি কোথাও, এই ব্যর্থ চেহারা মেয়েদের সামনে দেখাতে চায় না। নিজের থেকে পালিয়ে বাঁচতে চায় সে।
মুখভর্তি খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি, গোফ, মলিন ধুতি ফতুয়াতে বড্ড অন্যরকম লাগে সত্য নারায়ণকে। সেই সকালে বের হয় আর ফেরে বেশ রাত করে। মেয়েদের ঘুমানোর অপেক্ষা করে সত্য নারায়ণ। এত রঙহীন বিশ্রী জীবনে শুধু রুম্পা হেসে খেলে বাঁচে। ছোট ছোট হাত পা ছোড়াছুড়ি করে। আধো আধো শব্দে বাবা বলে ডাকে। বাবা ডাক প্রথম সোনালীর মুখে শুনেছে সত্য নারায়ণ। সোনালী তাকে বাবা হওয়ার অনুভূতি কেমন তা বুঝিয়েছে। এরপর এরপর কাবেরী, বেবি ওদের কাছেও বাবা ডাক শুনেছে সত্য নারায়ণ। তবুও রুম্পার হাসিমুখে আধো আধো বাবা ডাক শুনলে শিহরিত হয় সত্য নারায়ণ। সব কষ্টের মধ্যে রুম্পাই সবাইকে ভুলিয়ে রেখেছে। রুম্পা পৃথিবীর এই নিষ্ঠুরতা এখনো বুঝে উঠতে পারেনি। বাবা মায়ের অভাব, দারিদ্র্য বোঝে না সে। সত্য নারায়ণ রুম্পাকে দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মেয়েটা জানেই না বড় হতে হতে ওর সব হাসি মিলিয়ে যাবে, এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে ওর বাবা মা বড্ড অসহায়,অভাগা।
সময় এগিয়ে যায়, আভার শরীর প্রচণ্ড খারাপ হয়ে পড়ে। মাছের গন্ধ সহ্য হয় না আভার। সারাদিনে অসংখ্যবার বমি হয়ে শরীর নেতিয়ে পড়ে। চেষ্টা করেও বিছানা থেকে শরীর টেনে তুলতে পারে না আভা। মায়ের এমন অবস্থা দেখে সোনালী, কাবেরি চিন্তিত হয়ে পড়ে খুব। ওরা সিদ্ধান্ত নেয় মা সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত ওরা স্কুলে যাবে না। দুই বোন মিলে মায়ের দেখাশোনা করতে শুরু করে। সোনালী রান্নার দায়িত্ব নিয়ে নেয়। কাবেরী বাড়ির অন্যান্য কাজ করে। মাকে প্রচণ্ড ভালোবাসে ওরা। মায়ের সুস্থতার জন্য সব রকম চেষ্টা চালিয়ে যায়।
সময়টা মার্চের মাঝামাঝি। না শীত না গরম। আলো ঝলমলে রৌদ্রজ্জ্বল দিন। একটা ফুরফুরে বাতাস বয়ে যায়। দুপুরের পর থেকে পেটে ব্যথা শুরু করে আভার। শরীরটা ঘামছে খুব। বিছানায় শুয়ে দম বন্ধ লাগছে ওর। সারা ঘর হাঁটছে আভা। সোনালী একটু পরপর মাকে শরবত, পানি এগিয়ে দিচ্ছে। সন্ধ্যার পরপর সত্য নারায়ণ বাড়ি ফিরলো। হাতে ৩ কেজি চাল, সজনে ডাঁটা আর কিছু আলু। সত্য নারায়ণের মুখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট হয়ে ফুটে আছে। স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে আভা আর নিজের শরীরের কথা জানালো না আভা। নিষেধ করলো মেয়েদের যেন বাবাকে কিছু না জানায়। শরীর এখন ঠিক আছে আভার। রাতের খাবার খেয়ে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লো সবাই। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলো আভার। ব্যথা একটু কমেছিলো। ১০ গুণ হয়ে যেন ফিরে এসেছে সে ব্যথা। সময় হয়ে এসেছে, বুঝতে পারছে আভা। এবারেও যদি মেয়ে হয় না, না এসব আর ভাবতে পারছে না আভা।
চলবে...