সকাল থেকে সূর্যের দেখা নেই আজ। আকাশের মন খারাপ। এই পৌষের ভরা শীতে সে বিষণ্ন, ম্লানমুখে তাকিয়ে আছে পৃথিবীর চোখে। দূর থেকে জুটিটাকে দেখে ঠিক ঠাওর করে উঠতে পারেনি জুঁই। মনে হচ্ছিল দুটি ছেলে সামনা-সামনি বসা। কাছে আসতেই ভ্রম ভাঙে। ভারী জ্যাকেট আর কানটুপিতে ঢাকা জুটিটিকে আলাদা করে চিনতে পারেনি প্রথমটায়। অবশ্য পোশাক দেখে আজকাল ছেলে-মেয়ে আলাদা করতে যাওয়াও বোকামি। একুশ শতকের প্রায় সিকিভাগ পেরোনো এই সময়টাতে এ
সে ছেলে-মেয়ের আলাদা পোশাক বলে আর নেই কিছু। এখন পোশাক যে যখন পরে তখন তার। নির্দিষ্ট করে কিছু নেই। হাঁটতে হাঁটতে একদম কাছাকাছি এসে জুটিটিকে আলাদা করতে পারে জুঁই। খানিকটা চমকায়ও। ছেলেটা ততক্ষণে হাতের সিগারেটটায় লম্বা টান দিয়ে বাকি অর্ধেকটা বাড়িয়ে দিয়েছে মেয়েটার দিকে। চোখ সরিয়ে নেয় জুঁই। ক্যাম্পাস থেকে তারা পাস করে বেরিয়েছে সে-ও প্রায় বিশ বছর হতে চললো। এমন দৃশ্য কি তখন সহজ ছিল ক্যাম্পাসে? ভাবতেই মৃদু হাসির রেখা ফোটে মুখে। সে নিজেও বন্ধুদের সঙ্গে বসে সিগারেট টানত সেই দু হাজার দুই-তিন সালে। তাহলে এখন একসঙ্গে বসে একটা জুটি সিগারেট টানছে, তাতেই বা এমন ভিমরি খাওয়ার কী হলো তার? নিজেকেই নিজে ধমকায় জুঁই। বড্ড বুড়িয়ে গেছ কিন্তু মেয়ে! এই বিয়াল্লিশে এসে এমন বুড়িয়ে গেলে চলে? মাত্র তো জীবন শুরু! আরো কতটা পথ পড়ে আছে সামনে তোমার!
নিজেই শোনায় নিজেকে জুঁই। ক্যাম্পাসটা শীতে কেমন জবুথবু। আগের সেই জেল্লা নেই আর। লেকটা ফাঁকা। তাদের সময়ে লাল শাপলায় ভরা থাকত এই শীতে। তাতে ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে এসে বসত অতিথি পাখি। তন্ন তন্ন করে খোঁজে জুঁই। না। নেই। একটাও অতিথি পাখি নেই ক্যাম্পাসে। অদ্ভুত তো! প্রতিবছর সেই হেমন্তের শুরুতেই অতিথি পাখির ঢল নামে ক্যাম্পাসে। এবার কোনো আশ্চর্য অভিমানে তারা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে এদিক থেকে? অতিথি পাখি ছাড়া ক্যাম্পাসটাকে কেমন ন্যাড়া ন্যাড়া লাগে জুঁইয়ের। সামনে হাঁটতে থাকে আনমনে। চৌরঙ্গী পেরিয়ে বামে ঘুরে পুরাতন কলাভবনের সামনে গিয়ে বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। কেমন আদ্যিকালের বুড়োটে লাগে ভবনটাকে আজ। ভবনের গায়ে জুটেছে নতুন তকমা। এই পুরো ভবনটাই নাটক ও নাট্যকলা ডিপার্টমেন্ট এখন। জুঁইয়ের খুব ইচ্ছে করে একবার দোতলায় ওঠে, পুরোনো স্মৃতিগুলো ঝালিয়ে আসে চুপিসারে। দোতলায়ই ক্লাস হতো তাদের। বাংলা, ইংরেজি, ইতিহাস, দর্শন, আই আর, নাটক ও নাট্যতত্ত্ব, সব বিভাগের ঠিকানা ছিল এই পুরাতন কলাভবন। ক্লাসরুমের স্বল্পতায় কত দাঁড়িয়ে থেকেছে তারা, কোনো একটা ক্লাসরুম ফাঁকা হলেই হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়েছে তারা সদলবলে। বিশ্বজয়ের আনন্দ নিয়ে ক্লাস শুরু করেছে অতঃপর। অথচ এখন সব অন্যত্র চলে গেছে। ঠিক তাদের মতোই, পুরোনো ঠিকানা গুটিয়ে সবাই চলে গেছে নতুন ঠিকানায়, কেউ কারো খোঁজ জানে না আর। হায়! সময় কী নির্মমভাবে আলাদা করে দেয় চেনা সব হৃদয়ের তার! পুরোনো কলাভবনের ক্ষয়াটে জীর্ণ শরীরটার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ মিথুনের মুখটা মনে পড়ে জুঁইয়ের। কী ছটফটে আর আহ্লাদি মেয়ে ছিল মিথুন!
সারাক্ষণ লেগে থাকত রাহাতের সঙ্গে। ক্যাম্পাসের সবাই বলত ওদের নাকি সুপারগ্লু প্রেম। শুধু রাতে ঘুমোনোর সময়টুকু বাদে দুজনকে আলাদা দেখাই যেত না ওদের। একই ডিপার্টমেন্টে, একই ইয়ারে পড়ায় সারাক্ষণ একসঙ্গেই ঘুরতো ওরা। কিন্তু শেষপর্যন্ত পাতা ঝরে যায়। বিরহের সুর বাজে বাসন্তি হাওয়ায়। সেই চিরন্তন কথা, সেই গভীর ক্রন্দন, ‘যেতে নাহি দেব! হায়! তবু যেতে দিতে হয়, তবু চলে যায়’- ধ্বনিত হয় আকাশে-বাতাসে। কোনো একদিন মিথুন বাড়ি থেকে জরুরি ফোন পেয়ে চলে যায় ক্যাম্পাস থেকে। তারপর আর ফেরে না সে। দুদিনের কথা বলে সেই যে গেছিল মিথুন, আর সে ফিরল না কোনোদিন ক্যাম্পাসে। তার ছোটভাই এসেছিল মাসখানেক পরে, হল থেকে মিথুনের জিনিসপত্র নিয়ে গেছিল আর মিথুনের বিয়ের খবরটা জানিয়ে গেছিল সবাইকে। খবরটায় ভীষণ অবাক হয়েছিল জুঁই আর হলসুদ্ধ মেয়েরা। মিথুন কী করে বিয়েতে রাজি হয়েছিল কে জানে! আজকাল নাকি নিয়মিত সাইক্রিয়াটিস্ট দেখায় মিথুন, দুটো বাচ্চা আর বর নিয়েও ভোগে নিদারুণ বিষণ্ণতায়। রাহাত বরং তুলনামূলকভাবে ভালো আছে। মিথুনের বিয়ের খবরে কিছুদিন পাগল পাগল হয়ে ক্যাম্পাসে ঘুরত বেচারা, ভীষণ হতাশায় মুষড়ে পড়ে পড়াশোনা ছেড়ে উদাস হয়ে বসে থাকত লেকের পারে। তারপর হঠাৎই ঘুরে দাঁড়িয়েছিল রাহাত, পড়াশোনায় মন দিয়ে অনার্স শেষ করে বিসিএস দিয়ে পুলিশ ক্যাডার পেয়েছিল সে। তারপর আর পেছন ফিরে তাকায়নি কখনো, তরতর করে উঠে গেছে সাফল্যের চূড়ায়। এই পুরাতন কলাভবন এমন কত অলিখিত কাহিনির নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আজও। শুধু পুরনো সেই মুখগুলো হারিয়ে গেছে দূর থেকে দূরে, দেশ থেকে দেশান্তরে।
কতক্ষণ হা করে জীর্ণ ভবনটার চোখে চোখ রেখে তাকিয়েছিল খেয়াল ছিল না জুঁইয়ের, ঘোর কাটে একপাল ছেলে-মেয়ের হৈ হৈ রৈ রৈ কলতানে। ক্লাস শেষ করে নামছে ওরা। চোখে-মুখে নতুন দিনের স্বপ্ন, প্রানোচ্ছল, প্রাণবন্ত সব মুখ। দেখতেও ভালো লাগে। ‘কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই, আজ আর নেই’ আনমনে গানটা গুনগুন করতে করতে উল্টোপথে হাঁটতে থাকে জুঁই। কতদিন পর যে ক্যাম্পাসে এলো সে আজ! বন্ধুদের কারো সঙ্গে যোগাযোগ করেনি ইচ্ছে করেই। দলবেঁধে এলে আড্ডা হতো, গল্প হতো, স্মৃতিচারণ হতো, আরো অনেক কিছুই হতো হয়তো। ইচ্ছে করেই ওসব এড়িয়ে গেছে সে। কিছু সময় থাকে, যখন একাকিত্বটাই উপভোগ্য হয়ে ওঠে। উপভোগ্য হয়ে ওঠে নিজের সঙ্গে নিজের কথোপকথন। হুল্লোড়, আড্ডা থেকে তখন ছুটি চায় মন। আজ তাই সব ছেড়ে একান্তে এসেছে জুঁই, চেয়েছে পুরনো ক্যাম্পাসে নিজের ফেলে যাওয়া সেই সময়টা ছুঁয়ে দেখতে, হারিয়ে যাওয়া সেই সোনালি দিনগুলোর গন্ধ নিতে। কিন্তু কোথায় সেই প্রিয় ক্যাম্পাস! কোথায় সেই ফেলে যাওয়া দিন! তুমুল ব্যস্ত চারপাশ।
মানুষের বিরক্তিকর ভীড়, নতুন গজিয়ে ওঠা সব বিল্ডিংয়ের বাড়বাড়ন্ত চেহারা, অতিথি পাখির কোলাহলের বদলে গাড়ির হর্নের কান ঝালাপালা করা শব্দ, লেকের জলে লাল শাপলার অনুপস্থিতি আর পুরনো, চেনা সেই প্রিয় ক্যাম্পাসটার এমন ব্যস্তসমস্ত রূপ জুঁইয়ের মনটাকে ক্রমশ বিমর্ষ করে তোলে। চৌরঙ্গি পেরিয়ে সে আস্তে আস্তে তার সেই প্রিয় হলের দিকে হাঁটে। বাম পাশে ভিসি স্যারের বাংলো, ডানে তাদের সময়কার বিভাগীয় চেয়ারম্যান স্যারের কোয়ার্টার। দেখা মাত্র স্মৃতিরা এসে হামলে পড়ে মনে। কৃষ্ণচূড়ার সময়টাতে ভিসি স্যারের বাংলোর সামনের রাস্তাটা লালে লাল হয়ে থাকত একদম, মনে হতো রাস্তায় লাল কার্পেট বিছিয়ে রেখেছে কেউ, চোখ জুড়িয়ে যেত দেখে। পথটার দিকে তাকিয়ে খানিক থমকায় জুঁই। ডানে চেয়ারম্যান স্যারের কোয়ার্টার বিল্ডিংটা জরাগ্রস্ত, ম্লানমুখে দাঁড়িয়ে আছে একা। কতবার কত প্রয়োজনে স্যারের এই বাসাটাতে এসেছে তারা তখন। আজ কে কোথায়! স্যার কি বেঁচে আছেন এখনো? প্রশ্নটা মনে উঁকি দিয়েই হারিয়ে যায় মুহূর্তেই। স্মৃতিতে থাকাও আসলে একরকমের বেঁচে থাকাই। কোনো মানুষ যখন সবার স্মৃতি থেকেই মুছে যায়, তখনই মূলত তার মৃত্যু ঘটে, তখন সে সত্যিকার অর্থেই হারিয়ে যায় পৃথিবীর বুক থেকে, মুছে যায় চিরতরে। ভেবে, অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস গড়ায় বুকচিরে। কার কার স্মৃতিতে বেঁচে থাকবে জুঁই? মৃত্যুর পর কতদিন সে বেঁচে থাকবে পৃথিবীতে? না। তেমন কিছুই তো করা হলো না একজীবনে!
হলের সামনে এসে একটু থমকায় জুঁই। ভেতরে ঢুকবে? একটু দ্বিধা নিয়ে তাকায় ভেতরের দিকে। কোনো চেনা মুখ মিলবে না, ধরে নিয়েই এগোয় সামনে। হলের স্টাফরা সব অপরিচিত। নিজের ফেলে যাওয়া রুমটার সামনে গিয়ে চমকে যায় নিজেই। সে আর মিথুন রুমমেট ছিল, দুজন মিলে নীলক্ষেত গিয়ে দারুণ প্রাকৃতিক দৃশ্যের একটা পোস্টার কিনে লাগিয়েছিল রুমের দরজায়। পোস্টারটা এখনো অক্ষত! পোস্টারের ওপরে তার আর মিথুনের নাম লেখা, খানিকটা রঙজ্বলা, তবু পড়া যায়। হুড়মুড় করে দিনগুলো চলে আসে চোখের সামনে। সেইসঙ্গে চোখ ভরে যায় জলে। নক করবে বলে দরজায় হাত বাড়াতে গিয়েই থেমে যায় আবার। দরজায় ছোট্ট একটা তালা। আরেকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফিরতি পথ ধরে জুঁই। ‘জীবন গিয়াছে চলে আমাদের কুড়ি কুড়ি বছরের পার’! জীবনানন্দকে মনে পড়ে হঠাৎ। ‘খেলিছ, এ বিশ্বলয়ে, একেলা বিরাট শিশু আপনমনে, নির্জনে প্রভু নির্জনে, খেলিছ…’ নিজের পথে ফিরতে ফিরতে আবার গুনগুন করে সে।