জলের সিন্দুক ॥ দীপংকর গৌতম

ভাদ্র মাসের মাঝামাঝি সময় । সকাল থেকেই থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছিল। মাছের অপেক্ষায় থেকে থেকে অন্ধকার নেমে এসেছে চারদিকে। মধুমতির মাঝ থেকে এখন মোল্লাহাটগামী ইজিবাইকগুলো দেখা যায়। নদীতে মাঝে মধ্যেই ধোঁয়া ছেড়ে যাচ্ছে বাল্কহেড, ট্রলার এরমধ্যে মাছধরা ট্রলারও আছে। পাটগাতি বাজারের আলো যেন জলে ঠিকরে পড়ছে। বাতাস বইছে, মধুমতি দোলে দোলে মাছধরা নৌকা। 

‘আর যদি বিশ হালি ইলিশ ভগমান দিতো তয় এ বচ্ছর আর কিছু চাইতাম না কি কও খুড়ো’ নগেন একথা নৌকার আরেক মাথায় জাল ধওে থাকা ফটিকচাঁদকে বলে। ফটিকচাঁদ একটা হাসি দিয়ে বলে, খালি প্যাচাল পাড়তিছিস ক্যা? বৈঠায় টান মার। সোমায় এহনও আছে।’ আকাশের দিকে তাকিয়ে শিহরে ওঠে ফটিকচাঁদ ভাদ্র মাসে এমন আকাশ সে কোনোদিন দেখে নাই। আপন ভাইয়ের ছেলে নগেনকে সে বলে নগেন পাড়ের দিকে আউগাইতে থাক। ঢেউয়ের গতি ভালো লাগতেছে না। অন্য নৌকা থেকে ডাক আসে, খুড়া কি করবো? খুড়া জোরে বলে পাড়ের দিকে আউগাইতে থাক। এই ম্যাঘ যুইতের না। নগেন জোরে বৈঠা মেরে ডালিতে চাড়ি মারছে। নৌকা আগাচ্ছে পাড়ের দিকে। 

আবার সে খুড়াকে, প্রশ্ন করছে, কি খুড়া ,খারাপ কিছু ঠ্যাকছো? খুড়া উত্তর দেয় না। নগেন জোরে বৈঠা ঠেলছে। আর বিড়বিড় করে যা বলছে, তাহলো জেডিমার মুখ দেইখ্খা বাইর হওয়ার সময় কইছিলাম, খুড়া এই বাঝা মাইয়া মাইনসের মুখ দেইখ্খা বাইর হইলে সেদিন কপালে শনি থাহে। তাতো শোনলা না। কথা বলতে বলতে নৌকা আগাচ্ছে। এসময় খুড়া বললো নগেন, বৈঠা থামা, জাল ধরে বয়ঃবৃদ্ধ ফটিকচাঁদ ভাবে, কথাটা একদম মিছা না। ভালো কাজে রওয়ানা হইলে অনেকে নিয়ম কানুন মেনে চলতে হয়। প্রাচীন লোকেরা যা বলে গেছেন তাকে উল্টিয়ে দিলে হবে না তো। তবু আপন ভাইয়ের বউ আসলে তাকে কি করে ‘না’ বলা যায়। বড় দুঃখী মেয়ে, নিজের বাচ্চা-কাচ্চা নেই, জেলে পাড়ার সবার বাচ্চা-কাচ্চা সেই নিজে লালান-পালন করে বড় করে। এরজন্য কথাও কম শোনে না। কত জায়গায় বন্ধ্যা মেয়ে বলে মাঙ্গলিক কাজে অপমান হলেও আবার যায়। নিজের আপন ভাইটা মুখ তার মুখেই ভাসে। চন্দ্রমোহন, তার সদ্য প্রয়াত ছোট ভাই। তার সঙ্গে একই নৌকায় জাল বাইতো। সেবার বতরে(মৗসুমে) বের হলো ভালো মানুষটা । গ্যাসের সমস্যা ছিলো বলে ব্যাথা ওঠলে খাই সোডা খেত। তারপর একদিন কোজাগরী পূর্নিমার রাতে লক্ষ্মীপূজার দিন। তার কি হইলো আজহও সে বুঝে ওঠতে পারেনি। ভালো মানুষটা নদীতে এলো গিয়ে বাড়ির পূজার কাজ করবে। এরমধ্যে ব্যাথা উঠলো। নৌকায় গলাকাটা পাঁঠার মতো গড়াগড়ি করতে করতে এই মধুমতির জলের ওপরে থেকেই নাই হইয়া গেল। সে অবস্থায় ফকিরচাঁদকে ধরে বললো , দাদা-সীতারে দেইখো, তারপর আর নাই। ডাক্তারের কাছে, মধ্যরাতে নিলে ডাক্তার বললো , সে আর নাই। 

সোডায় নারী খেয়ে ফেলছে। তারপর থেকে তার বউটাকে নৌকা ছাড়ার সময় সবাই আসলে তাকে না বলে কিভাবে? ভাবতে ভাবতে তার চোখ ভাসে কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে। দুই ভাইয়ের মধ্যে একজন নাই হয়ে গেল। সে দুঃখের কথা নগেন বুঝবে কীভাবে? জাইলাগো জীবনই এমন। এখন জালের নৌকার অর্ধেক নগেনকে দেওয়া লাগে। নদীতে আগের মতো মাছ নাই। ইলিশের বতরে যা পায় সেটাই বড় আয়। এখন মহাজনীও তেমন নাই। মহাজনীর কালেও ছিলো আরেক জ্বালা। ইলিশ যতই উঠুক, বতরে সব ইলিশ মহাজনের কাছে দিতে হলেও, তার কাছে ধার দেনা করা যেত। এখনতো তাও হয় না। বাধ্য হয়ে নিজেদের মতো চলতে হয়। এখন আর নদীতে মাছ কই? জমিতে হাইব্রিড ধানের বিষ, সারের জল নদীতে মিশলে মাছের বীজতলা শেষ। পলি জমে নদীও ভরাট, এত উন্নয়ণ হয়, আর নদী ভরা দেশে একের পর এক নদী মরে যাচ্ছে। এখন পোলাপনরাও নদীতে আসতে চায় না। অন্য পেশায় চলে যাচ্ছে। মাছের দিন আর কই? বতরের মধ্যেও মাছের দেখা নেই। আগে ইলিশের বতর ছাড়াও কত মাছ নদীতে পাওয়া যেত। বতর শেষ হলেও বাজারে কত মাছ নিয়ে যেতে পারতো। সেসব এখন স্বপ্ন। ফকিরচাঁদ সেসব সব ভাবতে ভাবতে নগেনকে বলে জালে কী যেন বাধছে রে নগেন। হতাশ নগেন চুপ করে বসে থাকে আর ঠাকুরকে ডাকে। 
কি অইলো খুড়া? খুড়া চুপ করে জাল টানে। এবার নগেন বলে ট্যার পাও? খোট দিছে?

না খোটতো টের পাই না ফকিরচাঁদ উত্তর দেয়। নগেন বলে খুড়া বড় বাঘাইড় পড়লো নাকি? বাঘাইড় প্রথমে জালে পড়লে খোট মারে না। একটা বাঘাইড় পাইলে দেখবা বাজারে কী হুড়াহুড়ি। তার মনে মেঘলা আকাশেও আনন্দ ঝিলিক মারে। একটা বাঘাইড় পাইলে অনেক দিন আর গাঙে আসবো না। কিন্তু ফকির চাঁদের জাল আর নড়ে না। হাঙরের মতো ঢেউয়ে জাল না নড়ার কারণ কী? দুজনে ভাবতে থাকে। ফকির চাঁদেও জাল আর নড়ে না। রাত বাড়ে। অনড় দুজনে বসে জালে কি বাঁধলো সে ভাবনা করতে থাকে। মাছ পড়লে খোটতো দেবে। খোটই লাগে না। জাল আর ওঠে না। রাত বাড়ে। এখন পাটগাতি বাজারের আলো নিভে আসতে থাকে। রাত বাড়ে তবু ফকিরচাঁদ নদীতেই বসে থাকে। আগে তারা ঘাঘর নদীতে জাল বাইলেই, নৌকার খোল ভরে যেত মাছে। এখন আর সেদিন আসে না। বরং মধুমতিতে এসেও মছের দেখা পাওয়া যায় না। এর মধ্যে কী বাধলো জালে? নগেন বিরক্ত হয়ে বলে ‘যন্ত্রণার পরে টাডানি’ কি হইলো খুড়া? ট্যার পাও কিছু? ফকির চাঁদ উত্তর দেয়, নারে নগেন, কিছু ট্যার পাই না। নগেন জেলে পাড়ার অন্য নৌকাকে ডাকতে চায়, ফকির চাদ নিষেধ করে। বড় কোনো মাছ পড়লেই ভাগ দিতে হবে কিন্তু। কথা বলার সময় সব হিসাব করে কথা কবি। দাঁড়া দেহি বুঝি পরিস্থিতি কোনদিকে যায়। এক সময় না এক সময়তো খোট দেবে। এর মধ্যে অন্য নৌকা ডাক দিয়ে বলে, ওডবা নাকি। রাত কইলে বাড়ছে। ফকিরচাঁদের কোনো উত্তর নেই। এত কাল জাল বেয়ে পাকা জেলে ফকিরচাঁদ জাল ধরে বসে থাকে। তারপর এক সময় অন্য জেলেরাও জাল গুটাতে থাকে। 

নৌকা আসতে থাকে একের পর এক, নৌকায় কেরোসিনের মশালের মতো ল্যাম্পের আলোয়, রোদপোড়া, জরে ভেজা মানুষগুলোকে কালো রঙের মনে হয়। ধীরে ধীরে সবাই জড়ো হতে থাকে-আলোর মিছিল মনে হয় তখন নদীর মধ্যের ওই এলাকাকে। কিন্তু ফকির চাঁদ কিনারা পায় না কী করবে সে? বেশ কিছুক্ষণ পর সে নগেনকে ডেকে বলে, তোরা জলে নামতে পারবি ক’জন? সবাই নামতে পারবে কিন্তু মাছের ভাগ দিলে হবে হরেকেষ্ট বিড়িতে সুখটান দিতে দিতে বলে। কথাতাই। তারপর শুরু হলো ডুবা ডুবি। কেউ কিনারা করতে পারে না কী হলো? রাত ভোরে কয়েকজহন মিলে পাটগাতি লঞ্চঘাটের কাছে দাঁড় করে শ্যাওলা ভরা এক বিশাল সিন্দুক। শ্যাওলা সরিয়ে সরিয়ে দেখে ওতে অনেক সিঁদুর মাখা। অনেক শ্যাওলা ছাড়িয়ে খুলে ফেলার পর , এর গায়ের লেখা দেখে বোঝা যায় এটা সিকিরবাজারের শ্যাম সাহার বাড়ির মন্দিরের সিন্দুক। কিন্তু এই সিন্দুক এখানে এলো কীভাবে? পরে সিকিবাজারের অনেক বয়স্ক মানুষদের কাছে কথা বলে জানা যায়, ১৯৭১ সালে এই সিন্দুক লুট হয় রাতের আঁধারে। কারা এটা নিয়েছিল কেউ দেখেনি। তবে প্রাজ্ঞ লতিফ মিয়া বলেন, বাবা একাত্তরের কথা মনে করার আর দিন নেই। সেকথা বললে এখন কত লোক ক্ষেপে যাবে তার ঠিক আছে? 

সিকির বাজার বা এরআশপাশে যখোন লুট হয় তখনো পাকিস্তান বাহিনী এলাকায় ঢোকেনি। কিন্তু লুট শুরু হয়ে গেছে, মুক্তিযোদ্ধারা ট্রেনিং নিতে শুরু করেছে । এসময় অনেকে লুট করতো। আবার অনেকে কম দাম দিয়ে কিনতো। এমন ঘটনাও আছে যে এক বাড়িতে সুন্দর একখানা খাট দেখে আসছে, এস লুটারদের বলেছে ওইখাট লুট করে আন। টাকা দেব পাঁচশো। তখোন ৫০০ টাকা অনেক টাকা। ফলে ওইসব বাড়ি লুট হইছে। এরপর এরা অনেকে পাকিস্তানিবাহিনীর পক্ষে যোগ দিয়ে সব অপকর্মকে হালাল করেছে। এই লুটার বাহিনী একদিন সিকির বাজার লুট করে যাওয়ার পথে তারা পাটগাতি বাজারেও কিছু দোকানপাট লুট করে। লুটের সময় টের পায় যে মুক্তিযোদ্ধার পিছু নিয়েছে। তাই সিন্দুকের মতো ভারী জিনিপত্রের মালামাল রেখে তা জলে ফেলে দিয়ে পালিয়ে যায়। তারই একটি স্বাক্ষর এই সিন্ধুক। সারা রাত এত চেষ্টা করে সকালের আলো আভা মেলার মধ্যে সবাই সিন্দুকের পরিচয় জেনে গেছে। সিঁদুর লাগানো সিন্দুক বলে এটা কেউই কিনতে চাইলো না। কে আবার কোন বিপদে পড়ে কে জানে? ফকিরচাঁদও বললো ,আমি এই মন্দিরের সিন্দুক কোনোভাবেই বিক্রি করবো না। এলাকার লোকজনের ভিড়ে সবচেয়ে প্রবীণ মানুষ যিনি তিনি ফকির চাঁদ জলদাস। তাকে সবাই বললো তাহলে কী করা যায় আপনিই বলুন। ফকির চাঁদ সদ্য উদিত সূর্যের দিকে হাত জোর করে বললো- জলের সিন্দুক জলেই বিসর্জন দেই।