গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে দুর্বল নেতৃত্ব

গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর কৃষি খাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অস্থিরতা দেখা দেয়। এগুলোর মহাপরিচালক পর্যায়ে কিছু পরিবর্তনও হয়েছে। কিছু দপ্তর চলছে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা দিয়ে। কিন্তু নতুন সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে কৃষির অর্ধেক দপ্তরেই উৎপাদন বৃদ্ধি এবং সংকট মোকাবেলায় উৎসাহ ও দিকনির্দেশনামূলক বার্তা পৌঁছে দিয়ে পুনরায় কর্মচাঞ্চল্য সৃষ্টি করা যায়নি এখনো।

বাজারে সিন্ডিকেটের আধিপত্য না কমায় উদ্বেগ রয়ে গেছে কৃষি খাতের উৎপাদন নিয়েও। আবার সার, বীজ ও কীটনাশকের মতো প্রয়োজনীয় কৃষি উপকরণের সংকটও কাটেনি। যদিও এসব সংকট মোকাবেলায় এখন পর্যন্ত কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি কৃষি মন্ত্রণালয়। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, সরকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়গুলোর অন্যতম হিসেবে বিবেচিত কৃষি এখন চলছে দুর্বল নেতৃত্বে।

লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে যোগদান করেন গত ১৬ আগস্ট। এর মধ্যে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে দপ্তর বা সংস্থা আছে ১৮টি। এখনো এর অর্ধেক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক কোনো বৈঠকে বসতে পারেননি উপদেষ্টা। যদিও কৃষি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের দুই-এক মাসের মধ্যেই অধীন সব দপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকের রেওয়াজ রয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্বরাষ্ট্র ও কৃষি উপদেষ্টাকে এখনো দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়েই ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে বেশি। যদিও এখনো কাঙ্ক্ষিত মানে উন্নীত হয়নি দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যস্ততার মধ্যে কৃষিতে ঠিকমতো সময় দিতে পারছেন না কৃষি উপদেষ্টা।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন দপ্তরগুলোর তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ১৮টি বিভাগ ও অধিদপ্তরের মধ্যে ৯টিতেই এখনো কর্মকর্তাদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠক হয়নি কৃষি উপদেষ্টার। এগুলোর কয়েকটির কর্মকর্তারা উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকের চেষ্টা করেও তারিখ পাচ্ছেন না।

বিশ্লেষকরা বলছেন, কৃষি একটি কারিগরি, বৈজ্ঞানিক ও অর্থনীতির সংমিশ্রণে বিশেষায়িত একটি খাত। এখানে কৃষি খাতে অভিজ্ঞতা ছাড়া কেউ যুক্ত হলে তার গোটা বিষয়টি বুঝতেই অনেক সময় চলে যাওয়ার কথা। মন্ত্রণালয়টিতে সবসময়ই আলাদা একজন উপদেষ্টা প্রয়োজন। যদিও এখন কৃষিই সবচেয়ে বেশি অবহেলিত খাত। কৃষির সমস্যাগুলো প্রয়োজনীয় মাত্রায় গুরুত্ব পাচ্ছে না। ফলে উৎপাদন হ্রাস ও উপকরণ সংকটে খাদ্যনিরাপত্তার ঝুঁকি বৃদ্ধির বিষয়টি থেকেই যাচ্ছে।

কৃষিপণ্যের বাজার সরবরাহ ব্যবস্থায় বাজার ও উৎপাদন পর্যায়ে দাম নিয়ে কাজ করে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর। সাম্প্রতিক সময়ে ডিম ও মুরগির বাজারে অস্থিরতার সময়ে যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণের কাজ করেছিল সংস্থাটি। আনুষ্ঠানিকভাবে এখনো কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কোনো বৈঠক করতে পারেননি উপদেষ্টা। তবে কৃষি উপদেষ্টা একবার ফার্মগেটের খামারবাড়ির অধিদপ্তরে আকস্মিক পরিদর্শন করেছেন বলে জানিয়েছেন কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক। 

তুলা উন্নয়ন বোর্ডেও একবার আকস্মিক পরিদর্শনে গেছেন উপদেষ্টা। তবে বোর্ডের কর্মকর্তাদের সঙ্গে এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক বৈঠকে বসতে পারেননি তিনি। এটিরও প্রধান কার্যালয় খামারবাড়িতে।

বারবার আমন্ত্রণ জানিয়েও কৃষি উপদেষ্টার কোনো শিডিউল পায়নি ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা কেন্দ্র (বিনা)। কবে শিডিউল পাওয়া যাবে সে বিষয়ে কোনো তথ্য জানাতে পারেননি সংস্থাটির মহাপরিচালক ড. মো. আবুল কালাম আজাদও।

কৃষি খাতের নেতৃত্বে সবসময় অভিজ্ঞ কাউকে প্রয়োজন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের ভাষ্যমতে, এ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্তকে সবসময় দেশের কৃষি খাতের আনুষঙ্গিক বিষয় নিয়েই ব্যস্ত থাকতে হয়। একই ব্যক্তির পক্ষে একসঙ্গে স্বরাষ্ট্র ও কৃষির মতো গুরুত্বপূর্ণ দুটি মন্ত্রণালয়ের ভার সামলানো মুশকিল।

এ বিষয়ে কৃষি অর্থনীতিবিদ জাহাঙ্গীর আলম খান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘কৃষির সমস্যাগুলো কাছ থেকে দেখার জন্য দীর্ঘ অভিজ্ঞতার প্রয়োজন পড়ে। কারণ এটি কারিগরি, বৈজ্ঞানিক ও অর্থনীতির মিশেলে একটি বিশেষায়িত খাত। এখানে এখন বেহাল দশা। সার সংকট রয়েছে। বন্যায় উৎপাদন কম হওয়ায় চালের দাম বাড়ছে। কৃষির জন্য মাঠে প্রতিনিয়ত ছোটাছুটি করতে হয়। আউশ ও আমনের উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। আগামীতে বোরোর উৎপাদন কম হলে চালের দাম আর নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে না। খাদ্যনিরাপত্তাও বিঘ্নিত হতে পারে। তাই এ খাতে এমন উপদেষ্টা প্রয়োজন যিনি কৃষিতে সব সময়, সময় দিতে পারবেন।

দেশে চিনির উৎপাদন ও আমদানি—দুটোই এখন কমতির দিকে। উৎপাদন বাড়ানোর জন্য এ মুহূর্তে বাংলাদেশ সুগারক্রপ রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (বিএসআরআই) কাছ থেকে দায়িত্বশীল ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার প্রত্যাশা করা হচ্ছে। সরকার এরই মধ্যে কয়েকটি চিনিকল নতুনভাবে চালুর উদ্যোগও নিচ্ছে। এছাড়া কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস), বাংলাদেশ ফলিত পুষ্টি গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (বারটান), মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট (এসআরডিআই), বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং হর্টিকালচার এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনেও (হর্টেক্স ফাউন্ডেশন) দায়িত্বশীল ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার প্রয়োজন কৃষি উপদেষ্টার। 

সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, জনগণের খাদ্যনিরাপত্তার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত হলেও এখন কৃষিই সবচেয়ে অবহেলিত খাত। কৃষির সমস্যাগুলোকে যতটা গুরুত্ব দিয়ে দেখা দরকার ছিল তা হচ্ছে না। 

কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এসএম নাজের হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, কৃষিকে গুরুত্ব দেয়া হলে আলাদাভাবে কাউকে দায়িত্ব দেয়া হতো। কৃষির অনেক অফিস চলছে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা দিয়ে। তাই নীতিনির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলোও সেভাবে নেয়া যাচ্ছে না। অনেক সংস্কার কমিশন করা হলেও কৃষিতে কোনো কমিশন করা হয়নি।

সূত্র: বণিক বার্তা