গত বুধবার (৫ ফেব্রুয়ারি) রাত থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার রাত ৯টা পর্যন্ত রাজধানীর ধানমন্ডির ৩২ নম্বরসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়ি, কার্যালয় ও ম্যুরাল ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে।
ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেট, রংপুর, ময়মনসিংহসহ অন্তত ৩৫ জেলায় বিভিন্ন স্থাপনায় ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগের খবর পাওয়া গেছে।
ঢাকায় ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি ভাঙচুরের পর গত বুধবার রাতে খুলনায় ‘শেখ বাড়ি’ ভাঙচুর করা হয়। এরপর কুষ্টিয়ায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা হানিফের বাড়িতে হামলা চালানো হয়। গত দুদিনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা, সাবেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের কমপক্ষে ১৩টি বাড়ি ও বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে।
এছাড়া শেখ মুজিবুর রহমান ও শেখ পরিবারের সদস্যদের অর্ধশত ম্যুরাল ভেঙে ফেলা হয়েছে এবং আওয়ামী লীগের সাতটি কার্যালয়ে ভাঙচুর ও আগুন লাগানো হয়েছে।
ভোলায় তোফায়েল আহমেদ, নোয়াখালীতে ওবায়দুল কাদেরের বাড়িতে হামলা-ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ, বরিশালে সাদিক আবদুল্লাহ ও আমুর বাড়ি ভাঙচুর–আগুন, কুমিল্লায় এমপি বাহাউদ্দিনের বাড়িতে ভাঙচুর ও আগুন দেয়া হয়েছে। ঢাকার বাইরে আওয়ামী লীগের নেতাদের এসব বাড়িঘরে গত ৪ ও ৫ আগস্টেও হামলা, লুটতরাজ হয়েছিল। এরপর থেকে এসব বাড়িঘর পরিত্যক্তই ছিল।
গতকাল (৬ ফেব্রুয়ারি) রাতে নারায়ণগঞ্জ শহরের চাষাঢ়ায় আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের দাদার বাড়ি বায়তুল আমানে হামলা ও ভাঙচুর করেছেন বিক্ষুব্ধ জনতা। এ সময় এক্সকাভেটর দিয়ে ওই বাড়ির দেয়াল ও ছাদ ভেঙে দেয়া হয়।
অভিনেত্রী মেহের আফরোজ শাওনের বাবা জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সাবেক সদস্য মোহাম্মদ আলীর জামালপুরের বাড়িতে ভাঙচুর ও আগুন দেয়া হয়েছে। গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে সদর উপজেলার নরুন্দি ইউনিয়নের নরুন্দি রেলস্টেশন এলাকায় অবস্থিত ওই বাড়িতে আগুন ও ভাঙচুর করা হয়।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য মির্জা আজমের পরিত্যক্ত বাড়িতে আবারও ভাঙচুর করা হয়েছে। গতকাল সন্ধ্যা ৭টার দিকে জামালপুর শহরের বকুলতলা এলাকায় অবস্থিত আজমের বাড়িতে ভাঙচুর ও আগুন দেয়া হয়েছে।
খুলনা নগরের ময়লাপোতা এলাকায় অবস্থিত ‘শেখ বাড়ি’র একটি অংশ এক্সকাভেটর দিয়ে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে। গত বুধবার রাতভর দুটি এক্সকাভেটর চালিয়ে বাড়ির প্রধান ফটক, দেয়ালসহ বেশির ভাগ অংশ ভেঙে ফেলা হয়েছে।
কুষ্টিয়ায় এক্সকাভেটর দিয়ে ভাঙা হয়েছে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও কুষ্টিয়া-৩ (সদর) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মাহবুব উল আলম হানিফের বাড়ির একটি অংশ।
রাজশাহীর বাঘা উপজেলার চকসিংগায় অবস্থিত সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের বাড়িতেও আগুন দেয়া হয়েছে। গতকাল বেলা সাড়ে ১১টার দিকে আগুন দেয়ার ঘটনা ঘটে। উপজেলার মণিগ্রাম ইউনিয়নের সাফারি গ্রামে শাহরিয়ার আলমের ট্রেনিং সেন্টারে আগুন দেয়া হয়।
এ ছাড়া রাজশাহী মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ও স্বাধীনতা চিকিৎসা পরিষদের (স্বাচিপ) কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক মো. নওশাদ আলীর বাড়িতে, পিরোজপুরে সাবেক সংসদ সদস্য এ কে এম এ আউয়াল ও তার ভাই সাবেক মেয়র হাবিবুর রহমানের বাড়ি, নাটোর শহরে সাবেক সংসদ সদস্য শফিকুল ইসলামের (শিমুল) জান্নাতি প্যালেসে ভাঙচুর ও আগুন দেয়া হয়েছে। কুমিল্লায় সাবেক সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের বাড়িতে ভাঙচুর ও আগুন দিয়েছেন বিক্ষুব্ধ লোকজন। বুধবার রাত একটার দিকে এ ঘটনা ঘটে। পরে তারা পেট্রল ঢেলে বাড়িটিতে আগুন ধরিয়ে দেন।
ম্যুরাল ভাঙচুর
কিশোরগঞ্জ-ভৈরব আঞ্চলিক মহাসড়কের সদরের বিন্নাটি মোড়ে অবস্থিত শেখ মুজিবুর রহমানসহ জেলহত্যার ঘটনায় নিহত চার নেতা ও সাত বীরশ্রেষ্ঠর ছবি ও ম্যুরাল গতকাল সন্ধ্যার দিকে এক্সকাভেটর দিয়ে ভেঙে দেন বিক্ষুব্ধ জনতা। বুধবার রাত থেকে গতকাল পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন স্থানে শেখ মুজিবুর রহমান ও শেখ পরিবারের সদস্যদের কমপক্ষে অর্ধশত ম্যুরাল, ভাস্কর্য ও প্রতিকৃতি ভাঙা হয়েছে। কোথাও কোথাও গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ওই দিন রাতে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও নগরের জামালখান এলাকায় শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরাল ভাঙচুর করা হয়।
যশোরে শেখ মুজিবুর রহমান ও শেখ হাসিনার সাতটি ভাস্কর্য, ম্যুরাল ও নামফলক ভাঙচুর করা হয়েছে। বুধবার রাত সাড়ে ১১টা থেকে শুরু করে মধ্যরাত পর্যন্ত বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা হাতুড়ি দিয়ে এসব স্থাপনা ভাঙচুর করেন। সিলেটে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে শেখ মুজিবুর রহমানের ভাঙচুর হওয়া ম্যুরালটি এক্সকাভেটর দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে। সুনামগঞ্জ পৌর শহরের পাঁচটি প্রতিষ্ঠানে থাকা শেখ মুজিবুর রহমানের পাঁচটি ম্যুরাল এবং শহরের একটি পাড়ায় থাকা একটি মাজার বুধবার রাতে ভাঙচুর করেছেন বিক্ষুব্ধ জনতা।
ময়মনসিংহ নগরের সার্কিট হাউস মাঠসংলগ্ন এলাকায় শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরালটি বুধবার রাতে ভেঙে দেয়া হয়েছে। গতকাল সন্ধ্যায় নগরের পাটগুদাম ব্রিজ মোড়ের ‘জয় বাংলা চত্বরে’ মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ম্যুরালটি ভেঙে দেয়া হয়।
গতকাল বেলা ১১টার দিকে নারায়ণগঞ্জ শহরের চাঁনমারী এলাকায় জেলা প্রশাসকের কার্যালয় প্রাঙ্গণে শেখ মুজিবুরের প্রতিকৃতি ভাঙচুর করা হয়েছে।
এ ছাড়া সাতক্ষীরায় চারটি ও কিশোরগঞ্জে শেখ মুজিবের একটি ম্যুরাল, চুয়াডাঙ্গায় শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের চারটি ম্যুরাল, ঢাকার সাভারে শেখ মুজিবের একটি ম্যুরাল, যশোরের কেশবপুরে দুটি ম্যুরাল, কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরে সাবেক চার রাষ্ট্রপতির চারটি ম্যুরাল এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, নরসিংদী ও পঞ্চগড়ে একটি করে ম্যুরাল ভেঙে ফেলা হয়েছে। পটুয়াখালী জেলা পরিষদ চত্বরে স্থাপিত শেখ মুজিবুর রহমানের একটি ম্যুরাল ভাঙা হয়েছে।
আ.লীগের কার্যালয়ে হামলা
গত দুদিনে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে আওয়ামী লীগের বেশি কিছু কার্যালয়ে ভাঙচুর চালিয়েছেন ও আগুন দিয়েছেন বিক্ষুব্ধ জনতা। কিশোরগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়কে পাবলিক টয়লেট হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন ছাত্র-জনতা। মাদারীপুরে জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয় ভাঙচুর করেছেন যুবদল, ছাত্রদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা-কর্মীরা। গতকাল দুপুরে শহরের পুরান বাজার এলাকার দলীয় কার্যালয়ে এ হামলা চালানো হয়। জেলা যুবদলের সদস্যসচিব ফারুক ব্যাপারী বলেন, ‘মাদারীপুরে শেখ হাসিনার কোনো আস্তানা রাখা যাবে না। সবাই মিলে হাসিনার আস্তানা মুছে ফেলব।’
নওগাঁয় এক্সকাভেটর দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়। গতকাল বিকেল পাঁচটা থেকে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা ভাঙচুর শুরু করেন।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে গতকাল বিকেলে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর চালানো হয়েছে।
টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয় গুঁড়িয়ে দিয়েছেন বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা। গতকাল সন্ধ্যায় তারা জেলা আওয়ামী লীগের সদ্য প্রয়াত সভাপতি ও টাঙ্গাইল পৌরসভার সাবেক মেয়র জামিলুর রহমানের বাড়িতে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করেছেন। বিকেল পাঁচটার দিকে শহরের মেইন রোডে অবস্থিত জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনে শতাধিক ছাত্র-জনতা মিছিল নিয়ে যান। তারা এক্সকাভেটর দিয়ে অফিস ভবন গুঁড়িয়ে দেন।
চুয়াডাঙ্গায় জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয় ভাঙচুর করা হয়েছে। বুধবার রাত সাড়ে ১২টার দিকে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ের সামনে যান। তারা এক্সকাভেটর দিয়ে কার্যালয়ের প্রধান ফটক, গ্রিল, নিচতলার দেয়ালের অংশবিশেষ ভেঙে দেন।
এ ছাড়া পাবনার ঈশ্বরদীতে আওয়ামী লীগের কার্যালয়টিও ভেঙে দেয়া হয়েছে। কুড়িগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয় ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের নামফলক ভাঙচুর
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা সব নামফলক, গ্রাফিতি ও দেয়াললিখন মুছে দেয়া হয়েছে। পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে শেখ মুজিবুর রহমান ও শেখ হাসিনা আবাসিক হলের নামফলক এবং সরকারি এডওয়ার্ড কলেজের শেখ রাসেল আবাসিক হলের নামফলক ভেঙে দেয়া হয়েছে। বুধবার রাতে শেখ হাসিনার বক্তব্যের প্রতিবাদে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা বিক্ষোভ মিছিল শেষে ওই ভাঙচুর চালায়। এ প্রসঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন পাবনা জেলার আহ্বায়ক বরকতল্লাহ ফাহাদ বলেন, ‘দেশের কোথাও ফ্যাসিবাদের চিহ্ন থাকবে না। ফ্যাসিবাদের শেষ পরিণতি দেখে কেউ যাতে আর ফ্যাসিবাদ কায়েম করতে সাহস না পায়।’
কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটি হল থেকে শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যদের নাম মুছে দিয়েছেন বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। ভাংচুর করা হয়েছে রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও কারমাইকেল কলেজে থাকা শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরালেও। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল ও শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের নামফলক ভেঙে ফেলা হয়।
সর্বশেষ বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক সংসদ সদস্য শেখ সেলিমের বনানীর বাড়িতে ভাঙচুর ও আগুন দিয়েছে ছাত্র-জনতা। নিরাপত্তাজনিত কারণে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঘটনাস্থলে যেতে পারেনি।