জলদস্যু আতঙ্কে সাগর পাড়ের ১ লাখ ৪০ হাজার জেলে

সমুদ্র সম্পদের  অন্যতম উৎস হচ্ছে মৎসখাত। যা দেশের অভ্যন্তরীন প্রয়োজন মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করে বিপুল অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়। সেখানে আজ প্রতিবন্ধকতা। জলদস্যুদের অবাধ পদচারনায় জেলেরা সমুদ্রে মাছ ধরতে পারছে না। এদিকে সরকারের শিথিলতা আর উদাসীনতার সুযোগে দেশের সমুদ্র সীমা এখন বিদেশি জেলেদের দখলে। 

এসব জেলেরা আমাদের সমুদ্রসীমায় ঢুকে অবাধে মাছ শিকার করে আমাদের অর্থনৈতিক খাতকে পঙ্গু করে দিচ্ছে। তার উপরে গোদের উপর বীষ ফোঁড়া জলদস্যুদের উৎপাত। মাঝে মধ্যে সরকার তথা র‌্যাব কোস্টগার্ড অভিযান চালালেও নিয়ন্ত্রনে আসছে না জলদস্যুদের অপতৎপরতা। আমাদের সমুদ্রসীমায় ঢুকে বিদেশিরা চালাচ্ছে মাছ লুটের মচ্ছব। এমনটিই জানালেন সাগরপাড়ের মৎসজীবীরা।  

এদিকে জলদস্যুদের আতঙ্কে সাগর পাড়ের জেলেদের কান্না থামছে না। র‌্যাব ও কোস্টগার্ড বিশেষ অভিযান চালিয়ে অনেক জলদস্যুদের গ্রেফতার করলেও নেপথ্যে থাকা জলদস্যুরা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। কখন কে যে তাদের অপহরণ ও নির্যাতনের শিকার হয় তা নিয়ে দেশের বিভিন্ন জেলে পল্লীতে চলছে নানামুখি আলোচনা। এসব জেলেদের পণবন্দী করে আদায় করা হয় মুক্তিপণ ফলে সাগরপাড়ের জেলেদের ভিতরে দেখা দিয়েছে মুক্তিপণ আতঙ্ক।

পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চলের বঙ্গোপসাগর উপকূলীয় এলাকায় ১ লাখ ৪০ হাজার জেলের বসবাস। কক্সবাজার, মহেশখারী, টেকনাফ, চকরিয়া, উখিয়া, বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, ঝালকাঠি, বরগুনা, পাথরঘাটা, লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালী জেলা এলাকার বঙ্গোপসাগর থেকে জলদস্যুরা কোন না কোন দিন মাছধরার বোট (মাছ ধরার নৌকা) মাঝিকে অপহরণ করেছে। অধিকাংশই টেকনাফের সাগর মহনা, মহেশখালী মহনা, ভোলার চরফ্যাশন, ঢালচর, চরকুকরি-মুকরি, লালমোহনের বুড়া গৌরাঙ্গ, পটুয়াখালীর চরবিশ্বাস, মহিপুর, ফাতরারচর, সোনার চরসহ বিভিন্ন এলাকার বঙ্গোপসাগর ও অন্যান্য নদী মোহনা থেকে অপহরণ করা হয়। 

জলদস্যুরা ১ থেকে ২ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে বলে মাঝিরা জানান। জলদস্যুদের নির্ধারিত মুক্তিপণের টাকা দিতে অস্বীকার করলে তাদের খুন করা হয়। গত ১৯ ও ২০ ফেব্রুয়ারি পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চলের কক্সবাজার ফিসারি ঘাট, টেনাফ ও চকরিয়া এলাকার মাছ ধরার ট্রলার মালিক, জেলে-মাঝিল্লাদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

জানা গেছে, গত ২০ নভেম্বর রাতে গভীর সমুদ্রে জলদস্যুরা জেলেদের ইঞ্জিন চালিত নৌকায় অতর্কিত হামলা ও লুটপাট চালায়।  তারা  মুক্তিপণের জন্য বেশ কয়েকজন জেলেকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। অমানসিক নির্যাতন চালিয়ে স্বজনদের কাছ থেকে বড় অঙ্কের মুক্তিপণ আদায় করে। এরপর বরগুনা ও পাথরঘাটা জেলে পল্লীতে জলসদ্যু আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।জেলেরা জানায়, গণডাকাতির ঘটনায় বরগুনা ও পাথরঘাটা থানায় পৃথক দুইটি মামলা দায়ের করার পর র‌্যাবের বিশেষ টিম ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, পটুয়াখালীসহ আশপাশ এলাকায় টানা অভিযান চালিয়ে গত শুক্রবার পর্যন্ত ৬ জলদস্যুকে গ্রেপ্তার করেছে। তাদের কাছ থেকে মুক্তিপণের টাকাও উদ্ধার করা হয়েছে। 

গ্রেপ্তারকৃতদের দেয়া তথ্যমতে, পলাতক জলদস্যুদের চিহ্নিত করে গ্রেপ্তার করতে র‌্যাবের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে কথা হয় পাথরঘাটার জেলে বেলাল মিয়ার সঙ্গে। তিনি জানান,  বরগুনা পাথরঘাটার জেলে পল্লী এলাকার জেলেরা চলতি মৌসুমে ইঞ্জিনচালিত নৌকা নিয়ে মাছ ধরার উদ্দেশে বলেশ্বর নদী হয়ে গভীরসমুদ্রে ট্রলার নিয়ে ১০ থেকে ১২ জন এক সঙ্গে যান। গণডাকাতির পর টানা ১৩ দিন প্রায় মাছ ধরা বন্ধ ছিল। গত শুক্রবার থেকে আবার অনেকেই মাছ ধরতে যাওয়ার প্রস্তুতি  নিলেও সে মিশনে বাধ সাধে  সমুদ্র গর্ভে তৈরি হওয়া নিম্নচাপ। তারা আবহাওয়া অফিসের সতর্ক সংকেত মেনে মাছ ধরার জন্য সাগরে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তারা এখন পরিস্থিতির উন্নতির আশায় প্রহর গুণছেন।  

বরগুনা জেলে সমিতি সূত্রে জানা গেছে, বরগুনা জেলায় তালিকাভুক্ত জেলের সংখ্যা ৪৭ হাজার হলেও বাস্তবে আছে ৩২ থেকে ৩৩ হাজার, সঙ্গে তাদের পরিবারও রয়েছে। বরগুনার বলেম্বর, বিশাখালী, পায়রা, পাটুয়াখালীর নীলগঞ্জে একাধিক নদী রয়েছে। উপকূলীয়এসব নদী থেকে গভীর সমুদ্রেও জেলেরা মাছ ধরতে যান। তারা প্রায় সময় জলদস্যুদের কবলে পড়েন। আগে উপকূলে জলদস্যুদের উপদ্রব বেশি থাকলেও এখন অনেক কম। র‌্যাব সদস্য ছাড়াও কোস্টগার্ড নিরাপত্তা দিচ্ছে। র‌্যাবের টহল আগের চেয়ে বেশিবাড়ানোর দাবি করা হয়েছে। ফলে জেলেরা এখন আবার মাছ ধরতে নদী ও সাগরে যেতে সাহস পাচ্ছেন।

এদিকে গত ৪ ডিসেম্বর শনিবার রাতে পাথরঘাটা থেকে সর্বশেষ তথ্যে জানা গেছে, গত নভেম্ববর মাসে পাথরঘাটার একজন জেলে জলদস্যুদের হামলায় মারা গেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। নির্যাতনের শিকার এক জেলে এখনো অসুস্থ। জ্বরে আক্রান্ত। অর্থের অভাবে চিকিৎসা করতে পারছেন না। 

এ সম্পর্কে জানতে চাইলে বরগুনা সার্কেলের সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তোফায়েল আহমেদ সরকার বলেন, হঠাৎ করে সাগরে ডাকাতি বেড়ে যাওয়ায় জেলে ও শ্রমিকসহ মৎস্যজীবীদের নিয়ে পাথরঘাটা বিএফডিসি আড়তদার মালিক সমিতির কার্যালয়ে জরুরি মতবিনিময় সভা ডাকা হয়। ডাকাতি বন্ধ ও দস্যুতামুক্ত সাগর রাখতে ওই সভায় জেলেরা মতামত দিয়েছেন।

সভায় উপস্থিত সাধারণ মৎস্যজীবীরা জানান, গত এক সপ্তাহ ধরে বঙ্গোপসাগরে মাছধরার ট্রলারে ডাকাতি বেড়েই চলেছে। দিনে-রাতে সমানতালে অস্ত্র নিয়ে দস্যুরা সাগরে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। 

সাগরে গত মঙ্গলবার মুসা মুসল্লি নামে এক জেলেকে গুলি করে হত্যা করেছে ডাকাত দল। এ সময় গতকাল পর্যন্ত গত এক সপ্তাহে অন্তত ১৫টি মাছ ধরার ট্রলারে ডাকাতি করেছে জলদস্যু বাহিনী। মাছ ধরার ট্রলারের জ্বালানি তেল, মাছ, নগদ টাকা ও মোবাইল ফোনসহ বিভিন্ন মালামাল লুট করে নিয়ে যায়। এ সময় পাথরঘাটা ও শরণখোলা উপজেলার পাঁচ জেলেকে ১৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবিতে অপহরণ করেছে দস্যু বাহিনী। 

পাথরঘাটার ট্রলার মালিক ও মাঝি বাদল মোল্লা বলেন, সুন্দরবন সংলগ্ন মান্দার বাড়িয়া এলাকায় মাছ ধরার সময় আমাদের ট্রলারে হানা দিয়ে মাছ, তেল,ব্যাটারিসহ পাঁচ লাখ টাকার মালামাল লুট করে নিয়ে যায় ডাকাত দল। এ সময় ওই ট্রলারে থাকা ১৪ জেলেকে দস্যু বাহিনী বাঁশের লাঠি দিয়ে পিটিয়ে গুরুতর আহত করে। এ ডাকাতির সময় এক দস্যুর হাতে একটি পিস্তল ও একজনের হাতে বন্দুকছিল। 

বরগুনা জেলা মৎস্যজীবী ফিশিং ট্রলার শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক দুলাল হোসেন জানান, গত কয়েক বছরে সাগরে দস্যুতা তুলনামূলক কম ছিল। কিন্তু গতএক সপ্তাহ ধরে সাগরে দস্যুতা বেড়ে গেছে। গত এক সপ্তাহে সাগরে পাঁচ জেলেকে অপহরণ করে ১৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। এতে জেলেসহ মৎস্যজীবী পরিবারের সদস্যরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ কোস্টগার্ডের মহাপরিচালক রিয়ার এডমিরাল মো. জিয়াউল হক এর সঙ্গে যোাযোগ করা হলে তার অফিস সহায়ক হাসমত জানান, মহাপরিচালক এর সঙ্গে কথা বলতে হলে তার পিএস এস এম রউশন আলমের সঙ্গে কথা বলতে হবে। কিন্তু পিএসকেও পাওয়া যায় না। 

মহাপরিচালকের সচিব (অতিরিক্ত) কমান্ডার মো. মাশরিক-উর-রহিম এর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, এ বিষয়ে আমাদের গোয়েন্দারা কাজ করছে। কি পরিমাণ কাজ করেছেন বা কি কি কাজ গোয়েন্দারা করছেন এর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি মিডিয়া কর্মকর্তা লে. কমান্ডার সিয়াম এর সঙ্গে কথা বলতে বলেন। মি. সিয়াম বিষয়টি এড়িয়ে যান এবং বাগেরহাট শরনখোলার লে. মাহবুব এর সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। লে. মাহবুব এর মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি একটা মিটিং দোহাই দিয়ে পরে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলবেন বলে জানান। কিন্তু পরে আর কোন কথা বলেন নি। 

তবে দুবলা ফিশারম্যান গ্রুপের সভাপতি মো. কামাল উদ্দিন আহমেদ জানান, গত ২৬ জানুয়ারি রাতে মান্দার বাড়ীয়ার কাছে বঙ্গোপসাগর থেকে দুবলারচরের ১৫ জেলেকে অপহরণ করা হয়। তাঁদের মধ্যে ১০ জেলে জনপ্রতি ২ লাখ ৮০ হাজার টাকা মুক্তিপণ দিয়ে তিন-চার দিন আগে বাড়ি ফিরেছেন। তারা জলদস্যু মুক্ত মাছ ধরার নিরাপদ ক্ষেত্র তৈরিতে প্রশাসনের উদ্যোগ গ্রহণের দাবি করেছেন।