চীনের দুঃখ যেমন হোয়াং হো (প্রাচীন চীনে প্রায়ই বন্যার কারণে এই নদীর পানি ছাপিয়ে উঠে আশপাশের সব কিছু ভাসিয়ে দিত বলে একে চীনের দুঃখও বলা হয়) তেমনি বর্তমানে বাংলাদেশের দুঃখ নাফ নদী। নদীর ওপারের দেশটি মায়ানমার। সেখান থেকে বিভিন্ন সময়ে আমাদের দেশে অস্থিরতা তৈরি করা হচ্ছে। কখনও রোহিঙ্গা পাঠিয়ে যেমন আঞ্চলিক শান্তি বিনষ্ট করছে, তেমনি ভয়াবহ মাদকের চালান দিয়ে আমাদের যুব সমাজকে ধ্বংস করছে। যার বড় দায় রয়েছে এই নাফ নদীর। এই নদী দিয়েই দেশে মারণ নেশার বিস্তার ঘটছে।
পূর্বাঞ্চলে দেশের শেষ প্রান্ত টেকনাফ। ৭ বছর ৮ আট মাস পর নাফনদীতে মাছ ধরার সুযোগ পেলো ১০ হাজার জেলে। গত ১৮ ফেব্রুয়ারি থেকে মাছ ধরা নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ায় উচ্ছ্বসিত এলাকার জেলেরা। এই খবরে টেকনাফে ১০ হাজার জেলে পরিবারের মাঝে বিরাজ করছে উৎসবের আমেজ।
২০১৭ সালের ২৭ আগস্ট থেকে উখিয়া ও টেকনাফে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে এবং মাদকপাচার রুখতে নাফনদীতে মাছ ধরা বন্ধ করে দেয় তৎকালীন সরকার। তখন থেকে এ অঞ্চলের জেলে পরিবারের মধ্যে নেমে আসে দুঃখ-দুর্দশা। অনেক জেলে নাফ নদীতে মাছ ধরতে না পেরে দিনমজুর ও জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ করে সংসার চালাতে থাকেন। তাদের এই অসহায়ত্বের সুযোগ নেয় মাদক পাচারকারীরা।
জানা গেছে, পয়সার লোভ ধরিয়ে এসব জেলেদের দিয়ে মাদক-ইয়াবা পাচারের এক সিন্ডিকেট গড়ে তোলে। তাদের রুখতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যে ভুমিকা থাকার কথা ছিল সে সময় তারা তা রাখতে পারেনি। ফলে, অনেকটাই বেপরোয়া হয়ে ওঠে মাদক সিন্ডিকেট। টেকনাফে ৭ হাজার ৮৮৩ এবং উখিয়ায় ৩ হাজার ৩৯২ জন নিবন্ধিত জেলেদের পক্ষে সরকার তখন কোন বাস্তবোচিত পদক্ষেপ নেয়নি। ফলে অনেকেই মাদক সিন্ডিকেটের টোপ গিলে নিজেদের পরিবার বাঁচিয়ে রাখার কঠিন লড়াইয়ে নামে। এই ১০ হাজার জেলের কর্মসংস্থানের সুষ্ঠু ব্যবস্থা না নিয়ে নাফ নদীতে মাছ ধরার উপর নিষেধাজ্ঞা অনেকটাই হীতে বপিরীত হয়ে ওঠে। বর্তমান সরকার সেই সমস্যার সমাধান করায় এখন জেলে পল্লীতে বইছে আনান্দের বন্যা।
এদিকে টেকনাফের নাফ নদীতে মাছ ধরা নিষেধাজ্ঞা চলাকালীন কক্সবাজারের উখিয়া বালু খালী থেকে সেন্টমার্ন্টিন মোহনা পর্যন্ত ৬০ কিলোমিটার বিস্তৃতে নদীর জলসীমায় জেলেরা প্রবেশ করতে পারেনি। যদিও তখন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত এই নিষেধাজ্ঞা বলবত থাকে। নিষেধাজ্ঞার মার প্যাচে পড়ে ১০ হাজার জেলে পরিবারের প্রায় ৩০ হাজার সদস্যের দুর্দিন নেমে আসে। গত ১৯ ফেব্রুয়ারি টেকনাফ ও উখিয়া সরেজমিনে জেলে ও সংশ্লিস্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
শাহপরীর দ্বীপের জেলে মো.আব্দুল্লাহ বলেন, নাফ নদীতে এখন সরকারি বিধি নিষেধ না থাকায় মাছ ধরতে পেরে আমরা আনন্দিত। যখন নাফনদী বন্ধ ছিল তখন আট বছর পরিবার নিয়ে খুব দুশ্চিন্তা আর হতাশার মধ্যে দিন কাটিয়েছি। এখন নদীতে মাছ ধরতে গেলে মণ মণ মাছ মিলছে। এক-দুদিন মাছ ধরলে তিন-চার হাজার টাকা পাই। নৌকার মাঝিরাও হাজার হাজার টাকা পাচ্ছেন।
টেকনাফ জালিয়াপাড়ার ইমাম হোসেন বলেন, মাছ ধরলে সংসারের খরচ জোগাড় হয়। আর ধরতে না পারলে ধারদেনা করতে হয়। যখন নাফনদীতে মাছ ধরা বন্ধ ছিল,তখন নিরুপায় হয়ে সংসার চালাতে বনে গিয়ে জ্বালানি কাঠ এনে বাজারে বিক্রি করেছি। এখন আর কোনো চিন্তা নেই। সরকারি নিয়ম মেনে নদীতে জাল নিয়ে মাছ ধরছি। বড় বড় পোপা মাছ থেকে শুরু করে নদীতে ছুরি, চিংড়ি, বাটা, রূপচাঁদা, কোরালসহ সামুদ্রিক নানা প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়।
সাবরাং শাহপরীর দ্বীপের মেম্বর আবদুস সালাম বলেন, রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের পর নাফনদীতে মাছ ধরা বন্ধ ছিল। তখন কিছু জেলে সাগরে মাছ ধরতে যেত, সেখানেও আরাকান আর্মির যমদূত হয়ে দেখা দিত। এখন নাফ নদী খুলে দেওয়া হলো। ট্রলার ও নৌকার মালিকসহ জেলেদের পরিবারের মধ্যে আনন্দের ধারা বইছে।
এ বিষয়ে টেকনাফ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেন বলেন, নাফ নদীতে জেলেদের জালে এখন বড় বড় মাছ পড়ছে। গত শনিবার শাহপরীর দ্বীপের ৬-৭ জন জেলে নাফ নদীতে জাল ফেলেন। কয়েক ঘণ্টা পর জাল টানেন। এসময় ১৯৪ কেজি ওজনের বিশাল ভোল মাছটি জেলের জালে আটকে যায়। তবে জেলেদের কাছ থেকে প্রত্যাশা থাকবে ছদ্মবেশে কোনো ধরনের অপরাধে যেন তারা জড়িয়ে না পড়েন।
কথা হয় টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শেখ এহসান উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমাদের প্রত্যাশা জেলেরা মাছ শিকার করে সুন্দর মতো সংসার চালাবে। তবে বাংলাদেশ সীমানার মধ্যে মাছ শিকার করতে হবে।
জানা গেছে, বাাংলাদেশ সীমান্ত খুলে দেয়ায় রোহিঙ্গাসহ ইয়াবা গডফাদারদের ইশারায় বর্তমানে মিয়ানমার থেকে ইয়াবার চালান আসছে নাফনদী হয়ে টেকনাফে। গত ৮ বছর বেশী সময় ধরে জেলে পরিবারে দুর্দিন চললেও নাফ নদীতে মাছ ধরার অনুমতি মিলেনি। তখন থেকে টেকনাফ উপজেলার বিভিন্ন স্থানে অর্ধশতাধিক নৌকা ঘাটে নোঙর রাখতে হয়েছে। কিছু কিছু নৌকা অকেজো থাকায় এক সময় তা ব্যবহার অনুপযোগি হয়ে পড়ে। জেলেরা জানায়, রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের কারণে এমনিতেই নাফ নদীতে নানা সময়েই মাছ ধরার উপর বিজিবির বিধি নিষেধ থাকে।
সাগরে মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞার কালীন সময়ে এখানকার জেলেরা আরও বেশি আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়েন। জেলে পরিবারে অভাব-অনটন ভরপুর ছিল। বর্তমানে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করার ফলে তাদের সুদিন ফিরছে। নিষেধাজ্ঞা কালীন সময়ে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহকারী জেলেদের জন্য বিশেষ ভাতার ব্যবস্থা থাকলেও বেশিরভাগ জেলের ভাগ্যে সেভাতা জোটেনি জেলেদের অভিযোগ।
টেকনাফ মৎস্যজীবী সমিতির সভাপতি আবুল সালাম বলেন, প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা জারির পর টেকনাফের নাফ নদীতে মাছ ধরা সম্পূর্ণ বন্ধ ছিল। তাই নদী নির্ভর পরিবারগুলোতে চরম দুর্দিন চলছিল। বর্তমানে সে সমস্যা দূর হতে চলছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত নাফ নদীতে মাছধরা বন্ধ ছিল। কোন জেলে নদীতে জাল ফেলতে পারে নাই। ৮ বছর যাবৎ জেলেরা অনাহারে ছিল। সাবেক সরকারের কোন অনুদান জেলেদের ঘরে পৌছে নি। ইকু (এনজিও) অফিস থেকে টেকনাফে ২০১৯ সালে ১ হাজার জেলে পরিবারকে ছাগল ক্রেনার জন্য ১০ হাজার টাকার আর্থিক সহায়তা করা হয়।
সরেজমিনে জানা গেছে, টেকনাফের অনেক পুরনো জেলে ইয়াবা ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছেন। তাদের কারণে স্থানীয় ওঠতি যুবকেরাও মাদকের শিকার হচ্ছেন। টেকনাফের আব্দুর গনি, আব্দুর রহিম, আব্দুর শুক্কুর, হামিদ মাঝি, নুর মোহাম্মদ, আবুল কালাম, আবদু ছালামসহ অন্তত ২০ জেলে জানায় তাদের করুণ জীবনের কাহিনী।
তারা বলেছেন, মিয়ানমার থেকে ঢালাওভাবে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের আগে ভালই চলছিল প্রতিটি জেলে পরিবারের সংসার। নাফনদীতে জাল ফেলে তারা প্রতিদিন আহরণকৃত মাছ বিক্রি করে ২-৩ হাজার টাকা হারে উপার্জণ করতে পারত। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের পর তাদের সে সুযোগ দূর হয়ে যায়। অথচ নাফনদীতে (মিয়ানমার অংশে) রাখাইনে বসবাসরত রোহিঙ্গারা আগের মত জাল ফেলে মাছ ধরে নিয়ে যাচ্ছে।