অপরাধীর অভয়ারণ্য রোহিঙ্গা ক্যাম্প 

বাংলায় প্রবাদ আছে টাকা থাকলে বাঘের দুধ মেলে। তেমনি টাকা থাকলে যেকোন জিনিস সহজে মিলতে পারে। হোক সেটি সরকারি কোন গোপন নথি। দুর্নীতি যখন জাতিকে অষ্টপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলে তখন সত্যটি অসহায় হয়ে পড়ে তার বড় প্রমাণ দেশের অভ্যন্তরের রোহিঙ্গা ক্যাম্প। এখানে টাকা দিলেই নাগরিকত্ব এনআইডি মেলে যেটি এখন প্রমাণিত।

একশ্রেণির দেশদ্রোহী কর্মকর্তাদের কারণে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা এখন জাতির জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা টাকার বিনিময়ে ভূয়া জন্ম সনদের পাশাপাশি সংগ্রহ করেছে এনআইডি পর্যন্ত। আর তারই সুযোগে এসব রোহিঙ্গারা জড়িয়ে পড়েছে বহুবিধ অপরাধ কর্মকাণ্ডে। কেবল দেশের অভ্যন্তরেই নয় বিদেশের মাটিতেও তাদের অপরাধ কর্মাকাণ্ড দেশের ভাবমূর্তিতে আঘাত হানছে। তাদের অপরাধের তালিকায় মাদকের পাশাপাশি নারী ব্যবসার সঙ্গে যোগ হয়েছে অবৈধ অস্ত্রের কারবার। 

এছাড়াও তারা নিজেদেরকে বাংলাদেশি পরিচয় দিতে তৈরি করছে এনআইডি, জন্ম সনদ ও পাসপোর্ট। 

সম্প্রতি চক্রের ২৩ জনকে আটক করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বর্তমানে অপরাধীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প। এমন কোন অপরাধ নেই যার সঙ্গে ক্যাম্পের বাসিন্দাদের যোগাযোগ নেই। ঘিঞ্জি একই সঙ্গে সীমান্ত ও পাহাড়ি অঞ্চল বিধায় এসব অপরাধ ঘটিয়ে তারা গা ঢাকা দিতে সমর্থ হচ্ছে। তাদের অপকর্মের ভয়ে নিরীহ রোহিঙ্গারা মুখ খুলতে ভয় পাচ্ছেন। গোঁদের উপর বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘ আরসা’ ( আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি) নামক সশস্ত্র খুনিগোষ্ঠী। আরসা প্রধান আবু আম্মার জুনুনি ওরফে আতাউল্লাহ। সংগঠনটি এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি খুনের ঘটনা ঘটিয়েছে। ফলে তাদের বিরুদ্ধে কথা বলার মতো  ক্ষমতা কোন রোহিঙ্গার নেই।

এদিকে অপরাধীদের দলও ক্রমান্বয়ে শক্তিশালী হয়ে উঠছে। বিশেষ করে ত্রাণের উপর নির্ভর করে জীবন যাপনকারী রোহিঙ্গারা নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন। স্বদেশে ফেরত যাওয়া অনেকটাই অনিশ্চিত বলে মনে করছেন এসব  উদ্বাস্তুরা। ফলে নিজেদের ভাগ্য বদলাতে তারা খুন, অপহরণ, ধর্ষণ, অস্ত্র, মাদক পাচার, জন্ম নিবন্ধন, এনআইডি ওপাসপোর্ট তৈরি করে বাংলাদেশের জন্য ক্রমান্বয়ে হুমকি হয়ে উঠছে।

পাহাড় জঙ্গল এবং নদী সাগর থাকায় চোরাচালানের মাধ্যমে এখানে মাদক আনা নেয়া অনেকটাই সহজ। বর্তমান সময়ের ভয়াবহ মাদক ইয়াবা যা মিয়ানমার থেকে অবৈধ পথে এদেশে ঢুকছে। নাফ নদী পাড়ি দিয়ে এসব মাদক সংগ্রহ করা  একে বারেই পানি ভাত।  বন জঙ্গল আর পাহাড় নদীঘেরা পথ ধরে অবাধে এসব মাদক পরিবহন করা হচ্ছে। দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ এড়িয়ে অপরাধীরা এসব মাদক বহন করে নিজেদের একটি বাজার তৈরি করে নিয়েছে।

সেসব বাজারের ক্রেতা হিসেবে যেমন রোহিঙ্গা যুবক রয়েছে, তেমনি বাংলাদেশের অনেককেই এই বাজার থকে মাদক নিয়ে থাকেন। বিশ্বজুড়ে মাদকব্যবসা মানেই মাফিয়া কারবার। তাদের টাকা পয়সা ধন দৌলত  ক্ষমতা কোন কিছুরই অভাব নেই। একটু এদিক সেদিক হলেই তারা  পাখির মতো গুলি করে মানুষ খুন করে থাকে।
  
মাফিয়া চক্রের এই নেশা পেয়ে বসেছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বসবাসকারী মাদক চোরা চালানীদের ভিতরে। তাই বর্তমানে অপরাধীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে এসব ক্যাম্প।  অনেকের ভাষ্যমতে, অপরাধীরা নিজেদের প্রয়োজনে এসব শরণার্থী ক্যাম্পগুলো ব্যবহার করছে। যদিও সরকার ক্যাম্পগুলো সন্ত্রাস ও অবৈধ কর্মকাণ্ড রুখতে বহুবিধ পদক্ষেপ নিয়েছেন। তাই ড্রোন ক্যামেরা এবং ওয়াচ টাওয়ার স্থাপন করেও অপরাধ নিয়ন্ত্রনে আনা সম্ভব হচ্ছে না।  বরং উল্টো এসব প্রযুক্তির মাধ্যমে অপরাধীরা নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারে তা ব্যবহার করছে। মরার উপর খাঁড়ারঘা হয়ে দেখা দিয়েছে অবৈধ পথে তাদেরকে বাংলাদেশি নাগরিক বানানোর চক্রান্ত। সামান্য টাকা দিলেই মিলছে এনআইডি ও পাসপোর্ট। যদিও এই জালিয়াতি চক্রের বড় হোতারা সম্প্রতি র‌্যাবের হাতে ধরা পড়েছে।

এ বিষয়ে কক্সবাজার-১৪ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এবিপিএন) অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. ইহসানুল ফিরদাউস হকের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে প্রতিনিয়ত বিশেষ অভিযান চালানো হচ্ছে। বাড়ানো হয়েছে চেকপোস্টের সংখ্যা।ওয়াচ টাওয়ারের মাধ্যমে ক্যাম্প এলাকায় নজরদারি করা হচ্ছে। এখানে এমন একটি চক্রের সন্ধান মিলেছে যারা মাত্র ৫ হাজার  থেকে ১২ হাজার টাকায় ৬ ঘণ্টায় মিলত বাংলাদেশি হিসেবে ভুয়া জন্ম সনদ।

অন্যদিকে ২৫ হাজার টাকা দিলে ৩ দিনের মধ্যে পেতো জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) আর এক লাখ ২০ হাজার টাকায় দেয়া হতো পাসপোর্ট। এভাবে টাকার বিনিময়ে রোহিঙ্গাদের অবৈধ, ভুয়া বাংলাদেশি জন্মসনদ, এনআইডি ও পাসপোর্ট সরবরাহে জড়িত থাকার অভিযোগে জড়িত একটি চক্রের ২৩ জনকে গ্রেপ্তার করেছে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। 

প্রাথমিক জিজ্ঞাসা বাদের  গ্রেপ্তারকৃতরা এসব কাজে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে বলেও জানানো হয়েছে সংস্থাটির পক্ষ থেকে।

জানা গেছে, গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে দালাল ছাড়াও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর কয়েক জন রয়েছেন। ডিবি ও গ্রেপ্তারকৃতদের দেয়া তথ্যমতে, চক্রটি ২০১৯ সাল থেকে  রোহিঙ্গাদের এবং বাংলাদেশি অপরাধীদের ভিন্ন নাম ও ঠিকানায় পাসপোর্ট করে দিয়ে আসছিল বলে পুলিশ জানিয়েছে। রোহিঙ্গা ও অপরাধীদের জন্য ভুয়া জন্মসনদ, এনআইডি ও পাসপোর্ট তৈরির অভিযোগে প্রতারক চক্রের ২৩ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তাদের মধ্যে রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ, দালাল ও ২ জন আনসারসদস্য আছেন। 

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) লালবাগ বিভাগ রাজধানীর আগারগাঁও, মোহাম্মদপুর, যাত্রাবাড়ী, বাড্ডা এলাকায় গত বছর ২৩ ফেব্রুয়ারি অভিযান চালিয়ে ৩ রোহিঙ্গা নারী-পুরুষসহ ১৩ জনকে গ্রেপ্তার করে। এ সময় পাসপোর্ট সংক্রান্ত কাগজপত্র, পাসপোর্ট এবং কম্পিউটার জব্দ করা হয়। পরে তাদের দেয়া তথ্য মতে, গত বছর ২৫ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজার, টাঙ্গাইল ও ঢাকায় ধারাবাহিক অভিযান চালিয়ে ২ আনসার সদস্যসহ রোহিঙ্গা ও বাঙালি মিলিয়ে ৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের কাছ থেকে মোট ১৭টি পাসপোর্ট, ১৩টি এনআইডি, ৫টি কম্পিউটার, ৩টি প্রিন্টার, ২৪টি মোবাইল ফোন এবং পাসপোর্ট তৈরির সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র জব্দকরা হয়। 

যে প্রক্রিয়ায় পাসপোর্ট

প্রথমে চাহিদামত টাকা জমা নেয়া হতো। তার পরে যাদের পাসপোর্ট করা হবে সেসব রোহিঙ্গার কক্সবাজার, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি থেকে ঢাকায় আনা হতো। আরেকটি দল তাদের জন্ম সনদ, এনআইডি বানিয়ে দিত। আরেকটি দল ঢাকাসহ বিভিন্ন আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে আনসার সদস্যদের মাধ্যমে পাসপোর্টের ব্যবস্থা করে দিত।

এ বিষয়ে ডিবি পুলিশ জানায়, চক্রটি ৬ ঘণ্টার মধ্যে জন্ম সনদের জন্য ৫-১২ হাজার টাকা, ৩ দিনের মধ্যে এনআইডি করার জন্য ২৫ হাজার টাকা এবং পাসপোর্ট তৈরির জন্য ১ লাখ ২০ হাজার টাকা নিত বলে প্রাথমিকভাবে স্বীকার করেছে। ২০১৯ সাল থেকে চক্রটি রোহিঙ্গাদের এবং বাংলাদেশি অপরাধীদের ভিন্ন নাম ও ঠিকানায় পাসপোর্ট করে দিয়ে আসছিল। 

এ বিষয়ে কক্সবাজার জেলা প্রশাসক  মোহাম্মদ সালাহ্উদ্দিন এর সঙ্গে যোগযোগ করা হলে তিনি কোন সাড়া দেন না। তবে বিশ্বস্ত একটি সূত্র জানায়, অবিশ্বাস্য হলেও খোদ পুলিশ সুপারের সম্মতি নিয়েই বড় ধরনের ইয়াবা চালান বিক্রি করা হয়েছে। বিক্রির মোটা অঙ্কের টাকা ভাগাভাগি করে নিয়েছেন এসপিসহ পুলিশের দুর্নীতিপরায়ণ কতিপয় সদস্য। 

এমনকি ঘুসের ভাগ হিসাবে সোর্স নামধারী চাকরিচ্যুত দুই পুলিশ কনস্টেবলকে দেওয়া হয়েছে ১ লাখ ৩০ হাজার পিস ইয়াবা। অভিযানে আটক হওয়া চারজনের মধ্যে তিন শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীকে ১ কোটি ২০ লাখ টাকার বিনিময়ে ছেড়েও দেওয়া হয়।

গত ৬ জানুয়ারি চাঞ্চল্যকর এমন ঘটনাটি ঘটেছে দেশের ইয়াবা প্রবেশের অন্যতম রুট হিসাবে পরিচিত কক্সবাজারের রামুতে। এই ঘটনার একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তাৎক্ষনিক পুলিশ সুপার মুহাম্মদ রহমত উল্লাহকে কক্সবাজার থেকে পুলিশ হেড কোয়াটারে আনা হয়েছে বলে জানা গেছে।