চব্বিশের ৫ আগস্ট রক্তাক্ত পথ পেরিয়ে পতন ঘটে স্বৈরশাসকের। ছাত্র-জনতার তীব্র গণআন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। চূর্ণ হয়েছে তার দম্ভের অপশাসন। পুরো দেশজুড়ে যখন রক্ত ঝরছিল হঠাৎ করে শেখ হাসিনার আচমকা বিদায়ের খবর ছড়িয়ে পড়লে রাজধানী ঢাকাসহ দেশজুড়ে কারফিউ ভেঙে উল্লাসে মেতে ওঠেন ছাত্র-জনতা। রাজপথে নেমে আসেন নারী, শিশু, বৃদ্ধসহ সর্বস্তরের মানুষ। স্বৈরাচারের বিদায়ে সন্ধ্যার পরও সেদিন আনন্দ মিছিল চলছিল দেশজুড়ে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে অসহযোগ আন্দোলনের দ্বিতীয় দিনের ‘ঢাকা মার্চ’ কর্মসূচির মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে ৩৬ দিন আগে শিক্ষার্থীদের যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল তা সরকার পতনের আন্দোলনে রূপান্তরিত হওয়ার পর দেশজুড়ে সংঘাত আর নিরীহ মানুষের মৃত্যুর মধ্যে সেদিন শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা ছাড়তে হয়।
চব্বিশের সোমবার (৫ আগস্ট) দুপুরে বঙ্গভবন থেকে সামরিক হেলিকপ্টারে প্রথমে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বসিরহাট যান তিনি। সেখান থেকে উত্তরপ্রদেশের গাজিয়াবাদ বিমানঘাঁটিতে পৌঁছান।
ঐদিন আন্দোলনকারী, আওয়ামী লীগ কর্মী ও পুলিশের ত্রিমুখী সংঘর্ষে রক্তাক্ত রণক্ষেত্রে পরিণত হয় গোটা দেশ। সরকার পতনের এক দফা দাবিতে লাশের সারিতে ভয়াবহ ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় দেশজুড়ে। রাজধানী ছাড়িয়ে বিক্ষোভের আগুন পৌঁছে যায় শহর-নগর-গ্রামে।
স্বৈরশাসনের অবসানে অর্জনের আলোকিত দিন ৫ আগস্ট—এই দিনটি আজ আর শুধুই একটি তারিখ নয়, বাঙালির ইতিহাসে রক্তাক্ত গৌরব আর জনতার বিজয়ের প্রতীক। দীর্ঘ ১৭ বছরের স্বৈরাচারী শাসনের অবসান ঘটানো এই দিনটি হয়ে উঠেছে এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়, যেখানে লাখো নয়—কোটি মানুষ রাজপথে নেমে এনে দেয় ইতিহাসের মোড় ঘোরানো এক বিপ্লব। সেদিন লন্ডভন্ড হয়ে যায় শেখ হাসিনার দীর্ঘকালীন দমন-পীড়নমূলক ক্ষমতা। গণভবনের মসনদ থেকে বিতাড়িত হয়ে তিনি দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান। স্বৈরাচার পতনের সেই দিনটি স্মরণে ইতিহাস আজও কাঁপে।
চব্বিশের ৫ আগস্ট সকালটা ছিল ভিন্ন। অন্য দিনের চেয়ে অনেক বেশি থমথমে, অনেক বেশি আতঙ্কে ঢাকা ছিল চারপাশ। কারফিউ জারি করা হয়েছিল আগের রাতেই। তবু বাঙালি ঘুমায়নি। রাজধানীর পথে পথে টান টান উত্তেজনা। শহরের প্রবেশমুখে দেখা যায় লাখো মানুষের ঢল। তারা এসেছিল দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে। এসেছিল দলবদ্ধভাবে, পতাকা হাতে, গলা ফাটানো স্লোগান নিয়ে—‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক!’
যারা তরুণ, যারা বৃদ্ধ, নারী, শিশু—সবাই সেদিন একক কণ্ঠে জানিয়ে দিয়েছিল, আর নয়। শেখ হাসিনার দমননীতি, কোটা বৈষম্য, দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন আর গুম-খুনের বিরুদ্ধে তারা দিয়েছে সর্বোচ্চ ত্যাগ। কারফিউ ভেঙে হাজার হাজার মানুষ শহরে ঢুকতে থাকে। রাজপথে তখন প্রতিবাদ নয়, প্রতিরোধ। পুলিশের গুলি, টিয়ার শেল, জলকামান কিছুই আটকাতে পারেনি মানুষের পদচারণা। শহরের মোড় থেকে মোড়, অলিগলি থেকে রাজপথ—সব কিছু ভরে যায় বিপ্লবের আগুনে।