প্লট দুর্নীতি মামলায় আদালতের বিচার ও দণ্ডাদেশ নিয়ে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাগনি ব্রিটিশ এমপি টিউলিপ সিদ্দিক যে প্রশ্ন ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, তার জবাব দিয়েছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মোমেন।
মঙ্গলবার (২ ডিসেম্বর) সংস্থার জনসংযোগ দপ্তরের মাধ্যমে দেওয়া জবাবে তিনি বলেন, ‘সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত মিস টিউলিপ সিদ্দিকের বিচার ও দণ্ড সংক্রান্ত মন্তব্য ও উদ্বেগ স্পষ্টভাবে পর্যালোচনার দাবি রাখে।’
‘এ কারণে, একটি স্বাধীন সংবিধিবদ্ধ সংস্থা হিসেবে আমরা তার বিরুদ্ধে দায়ের করা সকল মামলার নথিপত্র পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা করেছি।’
ঢাকার চতুর্থ বিশেষ জজ আদালতের বিচারক রবিউল আলম সোমবার টিউলিপকে দোষী সাব্যস্ত করে দুই বছরের কারাদণ্ড দেন।
পাশাপাশি তার মা শেখ রেহানার ৭ বছর কারাদণ্ড এবং খালা শেখ হাসিনাকে ৫ বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। বাকিদেরও দেওয়া হয়েছে ৫ বছর করে কারাদণ্ড।
মামলার অভিযোগ ছিল, ঢাকা শহরে বাড়ি বা ফ্ল্যাট বা আবাসন সুবিধা থাকার পরেও ‘সেই তথ্য গোপন করে আইন ভেঙে দুর্নীতির মাধ্যমে’ শেখ রেহানা পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে ১০ কাঠার একটি প্লট বরাদ্দ নেন। শেখ হাসিনা ‘ক্ষমতার অপব্যবহার’ করে বোনকে প্লট বরাদ্দে ‘সহায়তা’ করেন। ব্রিটিশ এমপি টিউলিপ সিদ্দিক তার মা রেহানাকে প্লট পাইয়ে দিতে খালা শেখ হাসিনাকে ‘প্রভাবিত’ করেন।
দুদকের করা এই মামলায় টিউলিপের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির প্রতিক্রিয়ায় গত এপ্রিলে তার আইনজীবী অভিযোগ করেন, দুদক ‘প্রামাণিক নথির ভিত্তিতে’ টিউলিপের বিরুদ্ধে তদন্ত চালানোর কথা বললেও কোনো প্রামাণিক নথি উপস্থাপন করেনি।
সোমবার নিজের দুই বছরের কারাদণ্ড হওয়ার রায়কে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের ‘প্রতিহিংসা’ হিসেবে অভিহিত করেছেন টিউলিপ সিদ্দিক।
তার ভাষায়, পুরো বিচারপ্রক্রিয়াটি ছিল ‘বিশৃঙ্খল, হাস্যকর ও প্রহসনমূলক’।
মামলার বিষয়ে টিউলিপ বলেন, ‘অভিযোগে বলা হয়েছে, আমি ব্রিটেনে বিরোধী দলের এমপি থাকাকালে আমার রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে আমার খালাকে রাজি করিয়েছি, যেন তিনি আমার মাকে কোনো এক জায়গায় জমি কিনতে দেন।’
‘আমার খালার বয়স আমার চেয়ে দুই গুণ। তিনি আমার চেয়ে বহু বেশি ক্ষমতাবান এবং আমার জন্মের আগ থেকেই তিনি রাজনীতি করেন। আমি জানতে চাই, আমি যে তাকে প্রভাবিত করেছি, তার কী প্রমাণ আছে? পুরো বিষয়টাই ‘ক্যাঙ্গারু কোর্টের’ মতো মনে হয়, যা বিশৃঙ্খল, হাস্যকর ও সম্পূর্ণ প্রহসনমূলক।’
টিউলিপের এমন প্রতিক্রিয়ার জবাবে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, ‘মামলার নথিপত্র থেকে প্রতীয়মান হয় যে প্রতিটি মামলাই মিস সিদ্দিকের খালা (ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা), তার মা শেখ রেহানা এবং তার ভাই-বোন ও খালাতো ভাই-বোনদের নামে প্লট বরাদ্দ সংশ্লিষ্ট দুর্নীতির অভিযোগের সঙ্গে যুক্ত।
‘একটি বিচারাধীন মামলায় আরও দেখা যায়, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার খালার দায়িত্বকালীন সময়ে টিউলিপ সিদ্দিক নিজেও একটি অতিরিক্ত প্লট বরাদ্দ পেয়েছিলেন। শেখ হাসিনা, তার বোন শেখ রেহানা এবং টিউলিপ সিদ্দিকসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্য বিচার এড়াতে বর্তমানে পলাতক।’
তিনি বলেন, ‘তিনটি মামলার মধ্যে একটি মামলার বিচার ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে এবং সেখানে টিউলিপ সিদ্দিক তার মা ও ভাই-বোনদের জন্য প্লট বরাদ্দ নিশ্চিত করতে খালাকে প্রভাবিত করার অভিযোগে দুর্নীতির দায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন।’
আদালতে আনা অভিযোগের বরাতে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, ‘টিউলিপ সিদ্দিক তার খালাকে প্রভাবিত, প্রলুব্ধ ও রাজি করিয়েছিলেন, যাতে তিনি নিজের সরকারি অবস্থানের অপব্যবহার করে সিদ্দিক পরিবারের জন্য প্লট বরাদ্দ নিশ্চিত করেন।’
৩২ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণের বিষয়টি তুলে ধরে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, ‘এই সাক্ষীদের মধ্যে কয়েকজন শপথ নিয়ে বলেন যে টিউলিপ সিদ্দিক, যিনি তার খালার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত, সংশ্লিষ্ট প্লট বরাদ্দ পাওয়ার জন্য নিজের প্রভাব খাটিয়েছেন। তাদের সাক্ষ্য এবং টিউলিপ সিদ্দিক, তার মা ও ভাই-বোনদের নামে প্লট বরাদ্দের পারিপার্শ্বিক প্রমাণ, সব মিলিয়ে নির্দেশ করে যে তিনি প্লট সংগ্রহের অবৈধ প্রক্রিয়ায় গভীরভাবে জড়িত ছিলেন; শুধু ইতোমধ্যে নিষ্পত্তি হওয়া মামলাতেই নয়, অন্যান্য ক্ষেত্রেও।’
তিনি বলেন, এ ধরনের আচরণ দণ্ডবিধির ১৬১, ১৬৩, ১৬৪, ১৬৫(ক), ২০১, ২১৭, ২১৮, ৪০৯ ও ৪২০ ধারাসহ দুর্নীতি দমন আইন, ১৯৪৭-এর ৫(২) ধারার অধীনে অপরাধে সহায়তার শামিল।
আবদুল মোমেন বলেছেন, ‘এই পারিপার্শ্বিক প্রমাণ আরও শক্তিশালী হয় এই তথ্য দ্বারা যে টিউলিপ সিদ্দিক তার খালা ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ওপর নিজের প্রভাবের অপব্যবহার করে একটি প্লটও (প্লট নং সিডব্লিউএন(এ)-২৭, পরে পরিবর্তিত হয়ে প্লট নং ০৫, ব্লক এনই(এ), গুলশান, ফ্ল্যাট নং বি/২০১, হাউস নং ৫এ ও ৫বি, যাকে এখন ১১৫ ও ১১বি, রোড নং ৭১, গুলশান-২ নামে পুনঃনামকরণ করা হয়েছে) পেয়েছিলেন।
‘এগুলো কোনো দূরবর্তী কৃষিজমি নয়; বরং ঢাকার সবচেয়ে ব্যয়বহুল এলাকাগুলোর একটিতে অবস্থিত অত্যন্ত মূল্যবান প্লট। এসব প্লট এতটাই বৃহৎ যে সেখানে বড় আকারের বাসভবন বা বহুতল অ্যাপার্টমেন্ট ভবন নির্মাণ করা সম্ভব। জনসংখ্যার চাপ কমাতে ঢাকায় আবাসন প্রকল্পের জন্য সংরক্ষিত এই সরকারি জমি পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রীর নিকটজনদের মাঝে বরাদ্দ করা হয়, যা পারিবারিক সম্পদ বৃদ্ধিকে আরও বাড়িয়ে তোলে।’
দুদক চেয়ারম্যান বলেন, ‘টিউলিপ সিদ্দিকের সঙ্গে অফশোর কোম্পানির সহায়তায় কেনা লন্ডনের একাধিক সম্পত্তির যোগসূত্র পাওয়া গেছে। এতে একটি মৌলিক প্রশ্ন ওঠে, সরকারি দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা কীভাবে লন্ডন ও ঢাকার মতো দুটি ব্যয়বহুল নগরে একাধিক সম্পত্তি ক্রয়ের সামর্থ্য অর্জন করেন? আমরা এই বিষয়ে টিউলিপ সিদ্দিকের ব্যাখ্যা শুনতে আগ্রহী ছিলাম; কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তার অনুপস্থিতিতেই বিচার অনুষ্ঠিত হয়েছে।’
রায়ের পর যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম স্কাই নিউজে প্রতিক্রিয়া তুলে ধরে ব্রিটেনের ক্ষমতাসীন লেবার পার্টির এমপি টিউলিপ বলেন, ‘আমি পুরো ব্যাপারটা নিয়ে হতবাক। দেড় বছর ধরে আমার বিরুদ্ধে যেসব বিদ্বেষমূলক অভিযোগ ছড়ানো হচ্ছে, সেগুলো নিয়ে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে আমার সঙ্গে একবারও যোগাযোগ করা হয়নি। আমি দায়িত্বশীল থাকার চেষ্টা করেছি। যুক্তরাজ্যে আইনজীবী নিয়োগ করেছি, যারা বহুবার বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষকে চিঠি লিখেছে, কিন্তু কোনো জবাব পাইনি।’
তিনি বলেন, ‘এরপর আমি বাংলাদেশেই একজন আইনজীবী নিয়োগের চেষ্টা করি। তিনি আদালতে গিয়ে জানতে চেয়েছিলেন কী হচ্ছে। কিন্তু তাকে ভয় দেখানো হয়, হুমকি দেওয়া হয়, আর তিনি মামলা থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য হন।’
এ প্রসঙ্গে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, ‘টিউলিপ সিদ্দিকের দাবি যে তিনি অভিযোগের জবাব দেওয়ার সুযোগ পাননি, তা সম্পূর্ণ অসত্য। তাকে নিয়ম অনুযায়ী আদালতে উপস্থিত থাকা এবং নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। তিনি না স্বশরীরে আদালতে হাজির হন, না আইনজীবীর মাধ্যমে নিজেকে প্রতিনিধিত্ব করান।’
তিনি বলেন, ‘সামগ্রিকভাবে, এসব তথ্য বাংলাদেশ আইনের অধীনে দুর্নীতিতে সহায়তা ও প্ররোচনায় টিউলিপ সিদ্দিকের ধারাবাহিক সম্পৃক্ততা স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রমাণ করে। এই বাস্তবতা ও পরিস্থিতির আলোকে তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগে তিনি জড়িত নন—এমন দাবির কোনো ভিত্তি নেই।’
এ মামলার রায়ের আগে পূর্বাচলে প্লট দুর্নীতির অন্য তিন মামলায় গত বৃহস্পতিবার টিউলিপের খালা শেখ হাসিনাকে মোট ২১ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয় অন্য একটি আদালত। হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় এবং মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলকে দেওয়া হয় পাঁচ বছর করে কারাদণ্ড।
তার আগে গত ১৭ নভেম্বর জুলাই গণঅভ্যুত্থান দমানোর চেষ্টায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেখ হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ড দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
পূর্বাচলে প্লট দুর্নীতির আরো দুটো মামলা আদালতে সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে। ওই দুই মামলায় শেখ হাসিনা ও টিউলিপের সঙ্গে টিউলিপের ভাই রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি এবং আজমিনা সিদ্দিক রূপন্তীও আসামি।
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর তার ও আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ এক ডেভেলপারের কাছ থেকে লন্ডনে ৭ লাখ পাউন্ড দামের একটি ফ্ল্যাট ‘উপহার’ পাওয়ার খবর নিয়ে সমালোচনার মধ্যে গত জানুয়ারিতে যুক্তরাজ্যে সিটি মিনিস্টারের পদ থেকে ইস্তফা দেন টিউলিপ সিদ্দিক।
তার আগে আওয়ামী লীগের পতনের পরপর রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগেও টিউলিপের নাম আসে। বিষয়টি নিয়ে সে সময় ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমে তোলপাড় শুরু হয়। এরপর টিউলিপ ও তার বোনের পাওয়া ‘উপহারের’ ফ্ল্যাট নিয়ে শুরু হয় তুমুল আলোচনা।
মা-বাবার কাছ থেকে পাওয়া গুলশানের একটি ফ্ল্যাট টিউলিপ সিদ্দিক তার বোন রূপন্তীকে ২০১৫ সালে হস্তান্তর করেন। তবে সেই হস্তান্তরে যে নোটারি ব্যবহার করা হয় তা তদন্তে ‘ভুয়া’ প্রমাণিত হওয়ার কথাও বলেছে দুদক।