তরুণদের বিষয়ে প্রবীণদের ভূমিকা॥ শতদল বড়ুয়া

তারুণ্য এমন একটা ক্ষণ, যা হারিয়ে গেলে পাওয়া যাওয়া তো দূরের কথা, জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সব প্রচেষ্টা অতলেই তলিয়ে যায়। তাই মানবজীবনে তারুণ্য সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ধন। যৌবন জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সময়। জীবনকে গড়তে হলে তারুণ্যের যথার্থ ব্যবহার নিশ্চিত হওয়া চাই। আমরা বড়ই হতাশ, কারণ তারুণ্য বিক্ষুব্ধ বা বিক্ষোভ কিন্তু সৃজনশীল নয়, এটি কলঙ্কজনক এবং ধ্বংসাত্মক। হতাশায় পর্যবসিত হয়ে তরুণসমাজ আত্মবিনাশে মত্ত। এককথায় বলতে গেলে সব যেন লেজেগোবরে অবস্থা। বিশ্বব্যাপী আজ এ দৃশ্য প্রকট। প্রায় দেশের তরুণসমাজের একটা অংশ অন্ধকারজগতের বাসিন্দা। যারা এ পথে ধাবিত, তারা জীবন-মরণকে পরোয়া করছে না।
বিশ্বের ইতিহাস পর্যালোচনায় জানা যায়, মানুষের সভ্যতার পরতে পরতে যেসব যুগ প্রবর্তক ঘটনা, তার প্রায় অধিকাংশরই হোতা তরুণরা।

মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ যথার্থই বলেছেন, 'তরুণ জাতির অপশক্তি'। মনীষী বার্নাডার্স একবার বলেছিলেন, 'নতুন কিছু করাই তারুণ্যের ধর্ম। ইউরোপের রেনেসাঁ, ফরাসি বিপ্লব, রুশ বিপ্লবের ইতিহাস পর্যালোচনায় তারুণ্যের শক্তির পরিচয় পাওয়া যায়।

স্বাধীনতাসংগ্রামের কথাই ধরা যাক, দেশের তরুণসমাজ তখনকার সময়ে যে ভূমিকা রেখে ছিল তা আমরা সবাই জানি। তরুণসমাজের ঝড়োগতির ফসল বলা যেতে পারে স্বাধীনতাকালীন সবার ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা। দেশকে শত্রুমুক্ত করার সেই ক্রান্তিকালে আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা, ছাত্র-কৃষক-শ্রমিকরা অকাতরে ঢেলেছে বুকের তাজা রক্ত। তরুণদের অদম্য সাহসের জোরে, দেশবাসীর দেশের জন্য মমত্ববোধ প্রবল নাড়া দেওয়ার কারণে আমরা ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছি স্বাধীনতার লাল সূর্য। ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দ থেকে শুরু করে একুশে ফেব্রুয়ারি হয়ে এ পর্যন্ত যত বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম দেশের ইতিহাসে গৌরবময় অধ্যায় হয়ে আছে, সবকিছুর নেতৃত্বদানকারীরা হলো আমাদের এ দেশের যুবসমাজ।

১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দ স্বাধীনতাযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর গুলিতে পঙ্গু হয়ে বেঁচে আছে এখনো অনেকে। কারণ তারা ছিল মুক্তিযোদ্ধা। এককভাবে কাউকে তুলে না এনে যা বলতে চাই তা হলো দেশের জন্য যারা জীবন বাজি রেখে ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে যুদ্ধে ঝাঁফিয়ে পড়েছিল, তাদের সিংহভাগই তরুণ। তরুণসমাজের টগবগে রক্ত যখন শত্রুবাহিনীর শরীরে পড়েছিল তখন একটি কথাই জানান দিচ্ছিল পশ্চিমা হানাদারদের। তা হলো, এক তরুণ গেলাম পরপারে, লক্ষ তরুণের সারি দেখো পেছনে। পাকিস্তানি বাহিনীরা যুদ্ধকালীন এ কারণে তরুণদের বেশি টার্গেট করেছিল। তরুণসমাজ ক্ষেপে ছিল বলে সহসা আমরা শৃঙ্খলমুক্ত হয়েছি। ভোরের সূর্যের মতো পরিপূর্ণ ও সম্ভাবনাময় আমাদের সেই তরুণ আজ কালচক্রে মলিন।

১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের তরুণ আজ বৃদ্ধ বয়সে চরমভাবে হতাশ। কেন এমন হলো। হয়তো এর সঠিক উত্তর পাওয়া যাবে না। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের লাখ লাখ যুবক বর্তমানে বাকরুদ্ধ। কেউ তাদের আহাজারি শুনতে চায় না। সবচেয়ে দুঃখ লাগে যখন একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা তার সত্য কথা বলার জায়গা পায় না। আকুতি জানাতে পারে না বা কেউ আকুতি শুনতে চায় না। অমুক্তিযোদ্ধারা বহালতবিয়তে রয়েছে দেশের নামিদামি স্তরে। এই হলো দেশের প্রকৃত অবস্থা।

অমিততেজা আমাদের তারুণ্য আজ বড়ই বেকায়দায়। তারা উত্তরণের পথ খু্ঁজে না পেয়ে পা বাড়াচ্ছে সর্বনাশা পথে। যে হতে পারতো বরেণ্য কোনো ব্যক্তি, সে হারিয়ে যাচ্ছে কৃত্রিম কোলাহলে। যে হাতে শোভা পেতো কলম, আজ সে হাতে উঠছে অস্ত্র। যে যুবকসমাজে পারতো সৌরভ ছড়াতে, আজ সে কলঙ্কিত। চাঁদাবাজি, মাস্তানি- সবকিছুই আজ কিছু শ্রেণির যুবকরা করছে। অবৈধ মাদকদ্রব্য এবং চোরাচালানির গডফাদাররা নেপথ্যে থেকে ব্যবহার করছে তরুণদের। ঘরে-বাইরে সবখানেই একই অবস্থা বিরাজমান। কেন এমন হলো, এর কারণ অনুসন্ধান করা অভিজ্ঞমহলের প্রাণের দাবি।

আমাদের বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘তারুণ্য আলোর গানের, তারুণ্য কল্যাণের।’ হয়তো এ কারণে তারুণ্য সবসময় ন্যায় ও সত্যের জন্য পালন করে ঐতিহাসিক ভূমিকা। আমাদের দেশের তারুণ্যরা সব সময় সচেতন। এই সচেতনতাকে যদি দরদ দিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে ব্যবহার করা যায়, তাহলে দেশের চেহারা পাল্টে যেত। এই সমাজ কল্যাণ ও সমৃদ্ধির পথে স্রোতের পানির মতো বহমান থাকতো। কিন্তু আমাদের অপরিকল্পিত রাজনীতি সেই অধ্যায় আলোকিত না করে ছুটছে ভিন্ন পথে। তাই বিশ্বকবির ‘ওরে সবুজ ওরে অবুঝ’ তারণ্যকে পরিহার করা হলো।

সমাজের সর্বত্র যখন অনাচার, ব্যভিচার, শোষণ, বঞ্চনা, বৈষম্য, অসাধুতা তখন তারুণ্যকে উপযুক্তভাবে ব্যবহারের বদলে ঠেলে দেওয়া হলো ময়লা-আবর্জনার ডাস্টবিনে। তারুণ্যের ভেতরকার লুকায়িত জ্ঞানকে বিকশিত হওয়ার সুযোগ করে না দিয়ে আমাদের রাজনীতিবিদরা তরুণসমাজকে ব্যবহার করছে নিজ স্বার্থসিদ্ধির জন্য।

তার একবারও ভেবে দেখার গরজ মনে করলো না তরুণরা তো এ দেশের আগামীর কর্ণধার। আজ আমি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে নিরীহ যুবসমাজকে যেভাবে ব্যবহার করছি, এটা তো ক্ষণস্থায়ী। কাল ক্ষমতায় নেই তো চক্র বৃদ্ধিহারে সব হিসাব-নিকাশ বুঝিয়ে দিতে হবে দেশের তরুণসমাজকে। কারণ অন্যায়কারী সহজে পার পেয়ে যেতে পারে না। তাকে প্রায়শ্চিত্ত করতেই হবে।

হায়রে দুর্ভাগা মানবগোষ্ঠী, একি তোমার লীলাখেলা। রাজনৈতিক কারণের পাশাপাশি আরও কিছু সুনির্দিষ্ট কারণ বিদ্যমান যুবসমাজকে ধ্বংসের মূলে। বয়সের কারণে তারুণ্য একটু বেশি আবেগময় এবং উচ্ছ্বাসপ্রবণ। তারুণ্য কিছু একটা করতে চায়। সব পুরোনোকে পেছনে ফেলে নতুন জীবন আচ্ছাদনে হয়ে পড়ে মশগুল। অভিজ্ঞতা অর্জন করতে চায় নবো নবো আঙ্গিকে।

কবির ভাষায়, তারুণ্য হলো ঝঞ্ঝার মতো উদ্দাম, আকাশের মতো বাধাহীন। এসব সার্বিক কারণে তরুণরা ভালোবাসতে শিখে, নানা রঙিন স্বপ্নে বিভোর থাকে সারাক্ষণ। সে অভিমান প্রিয় কল্পনাবিলাসী। কিন্তু আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোতে তারুণ্যকে তো যথাযথভাবে কাজে লাগাচ্ছি না, উল্টো তারুণ্য যাতে ভালো কিছু করার সুযোগ না পায় সে ব্যবস্থা করছি। তারুণ্যকে নানাভাবে আটকিয়ে সুপ্ত প্রতিভাকে বিকশিত না হওয়ার অন্তরায় সৃষ্টি করা হচ্ছে।

ফলে অবরুদ্ধ তারুণ্য বিকল্প পথ খুঁজে। তারুণ্যের এ গতির কারণে সমাজ তথা দেশে অশান্তির দামামা বেজে ওঠে। দেশ যখন অস্থিরের শেষ সীমানায় উপনীত হয়, তখন তৃতীয় শক্তির তৎপরতা বেড়ে যায়। সুযোগকে কাজে লাগায় অপশক্তির লোকেরা। তারা তরুণদের ছলেবলে-কৌশলে নিজেদের করে নিয়ে হাতে গুঁজে দেয় কড়কড়ে নতুন নতুন টাকার নোট। নতুন টাকার সুবাসে তারুণ্য সুরক্ষিত হয়ে অধিক সুখ-আহ্লাদে বিভোর হয়ে পড়ে। তখন তারা কি করছে, তারা বুঝতে পারে না। নেশায় ডুবে ভুলে থাকতে চায় অশান্তির যত যাতনা। শুরু হয়ে যায় আইন হাতে তুলে নেওয়ার মতো ঘটনা।

এরা হারিয়ে ফেলে মমত্ববোধ, শ্রদ্ধাবোধ কি জিনিস তা তারা বেমালুম ভুলে যায়। সামাজিক রাজনীতি তারা মানে না। ব্যথিতদের দুঃখে তারা ব্যথিত হয় না। প্রচলিত সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে তারা উদ্দেশ্য হাসিলের পথে প্রধান হাতিয়ার হিসেবে গণ্য করে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও আমাদের তরুণ শক্তিকে ক্ষমতায় রাখতে পারছে না। কারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় চলছে রাজনৈতিক হিংস্র তৎপরতা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একপ্রকার অস্থিরতায় ভুগছে। পরীক্ষায় দুর্নীতি, সেশনজট, দলীয় রাজনৈতিক প্রভাব- সবকিছু কলেজকে করছে কলুষিত।

এরকম একটা অবস্থায় আশা, আশ্রয় ও আশ্বাসের জন্য যেই তারুণ্য আশায় বুক বাঁধছে, সে হয়ে পড়ছে নিজস্ব গৌরবময় ঐতিহ্যের শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন। টালমাতাল অবস্থায় সূতা ছেঁড়া ঘুড়ির মতো তারুণ্যকে উড়িয়ে নিচ্ছে নীল আকাশের অনন্ত ঠিকানায়। যেখানে নেই চলার শেষ, আসা যায় না ফিরে। ধ্বংস অনিবার্য, সে রকম একটা নির্দিষ্ট জায়গা।

তারুণ্য কিন্তু পিছু ফিরতে চায়, পিছু ডাকের অপেক্ষায় থাকে, ডাক পায় না বলে আর ফিরে আসতে পারে না। এর জন্য তো পরোক্ষভাবে আমরাই দায়ী। কেউ তাকে অনুপ্রাণিত করছে না, আশার বাণী শোনাচ্ছে না। কী চায় সে? তা আমরা আমলে নিতে চাই না। অভিমান সবাই করে। তারুণ্যের অভিমান ভাঙার কেউ নেই। এতে ঘটছে নানা বিপত্তি। তাই বলতে চাই, সৎ মানসিকতায় এগিয়ে আসতে হবে তরুণদের রক্ষায় প্রবীণদের।

লেখক:

সাংবাদিক, কলামিস্ট ও প্রাবন্ধিক