একটি সময় ছিল, যখন বাড়ির সামনে চিঠির বাক্সটির দিকে তাকিয়ে থাকতাম আর কয়েকদিন পরপর খুলে দেখতাম, হলুদ খামের আশায়। গ্রাম থেকে দাদার চিঠি, ছোট চাচা, মামাতো ভাই-বোন, কিংবা প্রিয় বন্ধু-বান্ধবীর হাতে লেখা সেই চিঠিটা—যার গায়ে একটি বিশেষ ডাকটিকিট লাগানো। চিঠি আসলে যেন একটি উৎসব লাগতো। ডাকপিয়ন কাঁধে কাপড়ের থলে ঝুলিয়ে ‘চিঠি চিঠি’ বলে ডাক দিলে বাড়িতে একটি আলোড়ন পড়ে যেতো। সেদিনের সেই উত্তেজনা, সেই আনন্দ আজ কোথায়?
আজকের ডিজিটাল যুগে চিঠি নামক জিনিসটা একটি পুরনো সিনেমার গল্পের মতো শোনায়। আমরা যারা নব্বইয়ের দশক কিংবা দুই হাজার সালের শুরুর দিকেও টিনএজার ছিলাম, তাদের জন্য চিঠি ছিল অনুভূতি বিনিময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। আজকের মতো তখন ফেসবুক, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার কিছুই ছিল না। মোবাইল ফোন তখন বিলাসিতার জিনিস। দূরের কারো সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র ভরসা ছিল এই চিঠি।
চিঠি লিখতে বসাটাও ছিল একটি রীতিমতো আনুষ্ঠানিকতা। প্রথমেই দরকার ছিল ভালো একটি লেখার কাগজ। অনেক সময় রঙিন কাগজ ব্যবহার করতাম। স্টেশনারি দোকানে পাওয়া যেতো চিঠি লেখার নানা রঙ ও ডিজাইনের প্যাড। এরপর একটি সুন্দর কলম। চিঠি লেখার শুরুটা হতো সম্বোধন দিয়ে—‘প্রিয়...’, ‘শ্রদ্ধেয়...’, ‘স্নেহের...’ ইত্যাদি। এরপর আসতো মূল কথাগুলো। আমরা আমাদের ভালোলাগা, মন্দলাগা, পড়ালেখা, সংসারের খুঁটিনাটি সবকিছুই লিখতাম চিঠিতে। কোনো দুঃখ থাকলে তা-ও লিখতাম। কোনো আনন্দের খবর থাকলে সেটা শেয়ার করতাম। বাসায় মুরগির কয়টি বাচ্চা হয়েছে, সেগুলো কী রঙের, দেখতে কেমন, পরীক্ষায় কেমন ফল করেছি ইত্যাদি বিষয়ে শৈশবে শেয়ার করতাম দাদা-মামা ও বন্ধুদের সঙ্গে। পছন্দের গান শোনার জন্য বাংলাদেশ বেতারের অনুষ্ঠান ‘অনুরোধের আসর গানের ডালি’ তে চিঠি লেখতাম পোস্টকার্ডে। যার মূল্য ছিল ১ (এক) টাকা।

চিঠি লেখার সময় মনে হতো, আমরা যেন কথোপকথন করছি। কলমের ডগা দিয়ে কাগজের ওপর শব্দগুলো যখন গুছিয়ে গুছিয়ে লিখতাম, তখন মনে হতো যেন আমরা আমাদের মনের কথাগুলোকে সাজিয়ে বলছি। কোনো ভুল হলে কাটাছেঁড়া করতাম। অনেক সময় একটি চিঠি লিখতে এক ঘণ্টা কিংবা তারও বেশি সময় লেগে যেতো। চিঠি লেখা শেষ হলে সেটা ভাঁজ করে খামে ভরতাম। খামের ওপর ঠিকানা লিখতে হতো খুব সতর্কভাবে। এরপর ডাকটিকিট লাগাতাম। ডাকটিকিটটা যেন হয় সুন্দর কোনো ডিজাইনের। শেষ পর্যন্ত চিঠিটা ডাকবাক্সে ফেলার পরও একটি অস্বস্তি কাজ করত—‘ঠিকঠাক লিখেছি তো?’, ‘ঠিকানাটা ভুল হয়নি তো?’
চিঠি পাঠানোর পর শুরু হতো অপেক্ষার পালা। কবে চিঠিটা গন্তব্যে পৌঁছাবে? কবে জবাবটা আসবে? তখন তো ট্র্যাক করার কোনো সিস্টেম ছিল না। শুধু ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে হতো। ডাকপিয়নের ডাক শুনলে বুকটা ধক করে উঠত। চিঠি হাতে পাওয়ার পর সেই খামটা খোলার সময়টা ছিল খুবই রোমাঞ্চকর। কে জানে কী লেখা আছে সেই চিঠিতে! চিঠি পড়ার সময়টা ছিল সম্পূর্ণ নিজস্ব। বারবার পড়তাম। চিঠির কথাগুলো মনে গেঁথে যেত।
চিঠি শুধু একটি বার্তা বহন করত না, এটি বহন করত আবেগ, স্পর্শ, আর ভালোবাসা। চিঠির কাগজে লেখকের হাতের স্পর্শ থাকতো। তার হস্তাক্ষর দেখে আমরা বুঝতে পারতাম তার মনের অবস্থা। কখনো চিঠিতে ফুলের পাপড়ি শুকিয়ে রাখতাম, কখনো বা ছবি আঁকতাম। এইসব ছোটখাটো বিষয়গুলো চিঠিকে করে তুলত আরো বেশি মূল্যবান।

গত দশ-পনেরো বছরে প্রযুক্তির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে চিঠির ব্যবহার কমতে শুরু করে। প্রথমে মোবাইল ফোন এলো। তখন ফোন করে কথা বলার সুযোগ তৈরি হলো। এরপর এলো ইন্টারনেট আর স্মার্টফোন। ইমেইল, এসএমএস, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ—এসবের মাধ্যমে মুহূর্তের মধ্যে যোগাযোগ করা সম্ভব হলো। এই তাৎক্ষণিকতা মানুষের জীবনকে গতি দিলো। এখন আমরা কোনো খবর পাঠাতে চাইলে সেকেন্ডের মধ্যে পাঠিয়ে দিতে পারি। জবাবও পেয়ে যাই সঙ্গে সঙ্গেই। এই সুবিধার কাছে চিঠির ধীরগতি টিকতে পারলো না।
চিঠি লিখতে সময় লাগে, ডাকযোগে পাঠাতে সময় লাগে, জবাব পেতেও সময় লাগে। আজকের ব্যস্ত জীবনে কে আর এত সময় দেবে? আমরা সবাই এখন ইন্সট্যান্ট পরিতৃপ্তি চাই। তাই চিঠি লেখার রীতি ক্রমশই বিলুপ্তির দিকে চলে গেলো। সেই সঙ্গে কমে যাচ্ছে আবেগ ও ভালোবাসা।
একসময় ডাক বিভাগের মূল কাজই ছিল চিঠি বিলি করা। আজ ডাক বিভাগের কর্মীরা বলেন, এখন ব্যক্তিগত চিঠি প্রায় আসেই না। ডাকঘরে এখন মূলত আসে ব্যাংকের চেক, কার্ড, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অফিসিয়াল চিঠি, সরকারি নোটিস, পার্সেল, ই-কমার্সের পণ্য ইত্যাদি। ডাক বিভাগও এখন চিঠির বদলে অন্যান্য সেবার দিকে জোর দিচ্ছে। তারা ডিজিটাল ব্যাংকিং, কুরিয়ার সার্ভিস ইত্যাদি চালু করেছে। একজন ডাকপিয়ন বললেন, ‘আগে আমার থলে ভর্তি থাকত চিঠি দিয়ে। এখন তো পার্সেল আর ডকুমেন্টের ভিড়ে দুই-চারটা চিঠি চোখেই পড়ে না। ব্যক্তিগত চিঠি তো মাসে-মাসে এক-আধটা আসে।’
চিঠি শুধু একটি যোগাযোগের মাধ্যম ছিল না, এটি ছিল একটি সংস্কৃতি। চিঠি লেখার মাধ্যমে আমরা আমাদের ভাষা, লেখার দক্ষতা, ভাব প্রকাশের ক্ষমতা বাড়াতে পারতাম। চিঠিতে আমরা গুছিয়ে প্রকাশ করতাম। এটি আমাদের ধৈর্য্য শেখাতো। অপেক্ষা করতে শেখাতো। আর চিঠি ছিল টেকসই। একটি চিঠি অনেক বছরও পড়া যায়। স্মৃতি হিসেবে সেটি সংরক্ষণ করা যায়। আজকের ডিজিটাল মেসেজগুলো কোথায় যে হারিয়ে যায়, তার কোনো খবরই থাকে না।
চিঠি হারানোর মানে হলো, আমরা হারালাম একটি নীরব সাক্ষীকে, যে আমাদের জীবনের নানা মুহূর্তের সাক্ষ্য বহন করে। হারালাম সেই উত্তেজনা, যখন ডাকপিয়নের ডাক শুনে ছুটে যেতাম। হারালাম সেই আনন্দ, যখন প্রিয়জনের চিঠি হাতে নিয়ে বারবার পড়তাম। হারালাম সেই সৌন্দর্য, যখন হাতে লেখা চিঠির পাতাগুলো সুন্দর করে সাজিয়ে রাখতাম অ্যালবামে।
চিঠি কি একদমই বিলুপ্ত হয়ে যাবে? আমার মনে হয় না। আজও কিছু মানুষ আছেন, যারা চিঠি লেখেন। বিশেষ করে বয়স্করা, যারা প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মেলাতে পারেন না, তারা চিঠির মাধ্যমেই যোগাযোগ রাখেন। আবার অনেক তরুণও এখন ‘ভিনটেজ’ কালচারের অংশ হিসেবে চিঠি লেখার প্রতি আগ্রহ দেখাচ্ছেন। তারা মনে করেন, চিঠিতে একটি রোমান্স আছে, একটি ব্যক্তিগত স্পর্শ আছে।
ডাক বিভাগও চাইলে চিঠি সংস্কৃতি ফিরিয়ে আনতে কিছু পদক্ষেপ নিতে পারে। যেমন, বিশেষ ডাকটিকিট প্রকাশ, চিঠি লেখা প্রতিযোগিতার আয়োজন, স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে চিঠি লেখার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করা ইত্যাদি।
জীবন যখন দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে, তখন হয়তো চিঠির মতো ধীর গতির জিনিসের জন্য খুব বেশি জায়গা নেই। কিন্তু এই দ্রুত গতির জীবনে আমরা যদি একটু থেমে ভাবি, তাহলে বুঝতে পারবো, আমরা আসলে কী হারিয়ে ফেলেছি। আমরা পেয়েছি গতি, কিন্তু হারিয়েছি ধৈর্য্য। পেয়েছি তাৎক্ষণিকতা, কিন্তু হারিয়েছি গভীরতা। পেয়েছি ভার্চুয়াল কমিউনিকেশন, কিন্তু হারিয়েছি রিয়েল কানেকশন।
চিঠি ছিল একটি শিল্প, একটি আবেগ, একটি ভালোবাসার প্রকাশ। আজকের দিনে আমরা যখন ক্লিক করেই হাজারো মানুষকে মেসেজ পাঠিয়ে দিচ্ছি, তখন সেসব মেসেজে কি চিঠির মতো সেই আবেগ, সেই শ্রম, সেই ভালোবাসা থাকে? আমার মনে হয় না। তাই আসুন, আমরা একটু সময় বের করে, আমাদের প্রিয় মানুষগুলোর জন্য একটি চিঠি লিখি।
লেখক: সাংবাদিক
ভাঙছে মেরুদণ্ড, ডুবছে শিক্ষা ॥ কাউছার খোকন
কাছেই হোক বা দূরে ভ্রমণেই জীবনের ঘ্রাণ ॥ কাউছার খোকন