টাকার রাজ্যে মানুষের মৃত্যু

আজকের সমাজ যেন এক অদ্ভুত প্রতিযোগিতার ময়দান—যেখানে সবাই দৌড়াচ্ছে, কিন্তু লক্ষ্য নেই; আছে শুধু লোভের দৌড়। সমাজে মানুষ ধীরে ধীরে ভুলে যাচ্ছে—মানবিক হওয়া মানেই মানুষ হওয়া। আমরা ক্রমশ এমন একসময়ে পৌঁছে গেছি, যেখানে সততা নয়, লোভই হয়ে উঠেছে সাফল্যের পরিমাপক। জীবনের প্রতিটি স্তরে ব্যবসা, রাজনীতি, প্রশাসন, চিকিৎসা, শিক্ষা—সবখানেই লোভের বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়েছে। সমাজের নৈতিক ভিত্তি আজ কেঁপে উঠেছে টাকার নেশায়। লোভ মানবীয় দুর্বলতা; কিন্তু যখন লোভই সমাজের চালিকাশক্তি হয়ে ওঠে, তখন সেটি ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনে। আমরা এমন এক সমাজে বাস করছি, যেখানে সততা এখন দুর্বলতার প্রতীক, আর অসততা, প্রতারণা, চাতুর্য—এগুলোকে বলা হচ্ছে ‘কৌশল’। এই পরিবর্তন কেবল অর্থনৈতিক কাঠামো নয়, মানুষের মানসিক গঠনকেও পাল্টে দিয়েছে।

ব্যবসায়ী পণ্য বিক্রি করেন মুনাফার জন্য—এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যখন মুনাফার মোহে মানুষ স্বাস্থ্য, জীবন, এমনকি শিশুর ভবিষ্যৎ নিয়েও ঠাট্টা করে, তখন সেটি আর ব্যবসা থাকে না, হয়ে যায় শোষণ। সরকারি অফিসে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দায়িত্ব পালন নয়, বরং ঘুষের সুযোগ খোঁজেন। দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থে বিলাসী জীবন কাটান, অথচ তাদের দায়িত্ব ছিল জনগণের সেবা করা। নেতা ও জনপ্রতিনিধিরা ক্ষমতার সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠেন জনগণের ভোটে, কিন্তু ক্ষমতায় পৌঁছে যান দুর্নীতির রাজ্যে। ক্ষমতা যেন তাদের কাছে নৈতিকতার নয়, ব্যক্তিগত সম্পদের উৎসে পরিণত হয়।

একসময় চিকিৎসক সমাজ ছিল মানবতার প্রতীক—‘সেবাই ধর্ম’ ছিল তাদের মূল নীতি। কিন্তু আজ অনেক চিকিৎসকই রোগী নয়, কমিশনের হিসাব কষেন। ওষুধ কোম্পানির প্রলোভন, ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কমিশন, বিদেশি ভ্রমণের অফার—সবকিছু মিলিয়ে চিকিৎসা একপ্রকার বাণিজ্যে পরিণত হয়েছে। লোভের এই আগুন থেকে চিকিৎসা পেশাও রেহাই পায়নি। ডাক্তারদের অনেকেই আজ রোগীকে আর মানুষ হিসেবে দেখেন না, তারা হয়ে পড়েছেন কমিশনের হিসাবের অঙ্ক। এই বাস্তবতা আমাদের চিকিৎসাব্যবস্থাকে মানুষের সেবার জায়গা থেকে সরিয়ে ঠেলে দিয়েছে ব্যবসায়িক মঞ্চে। একসময় যে পেশা মানবতার প্রতীক ছিল, সেটিই আজ অর্থের প্রতিযোগিতায় কলুষিত।

শিক্ষা হলো জাতির আত্মা। কিন্তু আজ শিক্ষাক্ষেত্রেও লোভ ও প্রতিযোগিতার বিষ ঢুকে গেছে। শিক্ষক, যিনি জ্ঞানের আলো ছড়ান, তিনিও বাধ্য হচ্ছেন প্রাইভেট টিউশনির জালে জড়াতে। কারণ জীবিকা নির্বাহের কঠিন বাস্তবতায় শিক্ষা এখন একপ্রকার বাণিজ্য। একসময় শিক্ষার্থীর সাফল্য ছিল শিক্ষকের গর্ব, এখন তা হয়ে দাঁড়িয়েছে আয়ের পরিমাণের প্রতিফলন। শিক্ষাক্ষেত্র, যা হওয়া উচিত ছিল সমাজে নৈতিকতার উৎস, আজ তাও ধীরে ধীরে হারাচ্ছে তার জ্যোতি। বেঁচে থাকার লড়াই যেমন বাস্তবতার দাবি, তেমনি শিক্ষাক্ষেত্রে নৈতিক অবক্ষয়ের গভীর দৃষ্টান্ত। যখন শিক্ষা হয় ব্যবসার পণ্য, তখন সমাজ হারায় তার আত্মা। ছাত্ররা জ্ঞান নয়, সার্টিফিকেটের পেছনে দৌড়ায়; শিক্ষকরা জ্ঞানের আলো নয়, আর্থিক সান্ত্বনা খোঁজেন। ফলে শিক্ষা থেকে হারিয়ে যাচ্ছে মূল্যবোধ, শ্রদ্ধা ও মানবতা। তাছাড়া সামাজিক সম্পর্কগুলো আজ প্রায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে।

এই লোভ ও নৈতিক অবক্ষয়ের সংস্কৃতি শুধু ব্যক্তিগত নয়, এটি এখন রাষ্ট্রীয় কাঠামোতেও প্রবেশ করেছে। সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে রাজনৈতিক দল—সবখানেই দুর্নীতি যেন এক অঘোষিত প্রথা। ফাইল সরাতে হয় ঘুষ, সুযোগ পেতে হয় সুপারিশে, উন্নয়ন প্রকল্প মানে হয় লুটপাটের খেলা। প্রশাসনিক ব্যবস্থায় যোগ্যতা নয়, দলীয় পরিচয় ও স্বার্থসংশ্লিষ্টতা হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রধান যোগ্যতা। রাষ্ট্রযন্ত্রের ভেতরে এই অনৈতিক প্রবণতা জাতির ভবিষ্যৎকেও গ্রাস করছে নিঃশব্দে। লোভ মানুষকে চরম আত্মকেন্দ্রিক, স্বার্থপর এবং অন্ধবিশ্বাসী করে তোলে। আর যার ভয়ংকর পরিণতি দেখি সংর্ঘষ এবং রক্তারক্তিতে।

একদিকে ব্যবসায়ীর লোভ অতি মুনাফায়, অন্যদিকে নেতার লোভ ক্ষমতা আর দুর্নীতিতে; অফিসের কর্মচারী ঘুষে, ডাক্তার কমিশনে, শিক্ষক টিউশনিতে—এ যেন গোটা সমাজের প্রতিচ্ছবি। আর আমরা সাধারণ মানুষ প্রতিদিন এই লোভের আগুনে দগ্ধ হতে হতে শুধু টিকে থাকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি। লোভ মানুষকে অন্ধ করে দেয়; অন্ধ মানুষ সত্য, ন্যায়, বিবেক—কিছুই দেখে না। এই অন্ধত্বই আজ সমাজকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দিয়েছে। রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব নাগরিকের কল্যাণ নিশ্চিত করা। কিন্তু যখন রাষ্ট্রীয় যন্ত্র নিজেই দুর্নীতির ফাঁদে পড়ে, তখন সমাজে ন্যায়বিচার ও সমতা দুটোই বিলীন হয়ে যায়। সরকারি অফিসে কাজের বিনিময়ে ঘুষ, উন্নয়ন প্রকল্পে তদবির, সরকারি নিয়োগে দলীয় সুপারিশ—সবকিছুই আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থাকে পঙ্গু করে তুলছে। আমরা বড় হয়েছি এমন এক সমাজে, যেখানে সততা হাস্যকর, নীতি অবাস্তব, আর লোভ বাস্তবতার অপর নাম। কিন্তু যদি এই অবস্থার পরিবর্তন চাই, তবে আমাদের ফিরতে হবে মূল্যবোধের মূল শিকড়ে—শিক্ষায়, পরিবারে, নীতিতে ও বিবেকে। মানুষের ভেতরের মানুষটিকে জাগাতে হবে। নইলে লোভের এই সমাজ একদিন শুধু অর্থে নয়, আত্মাতেও দেউলিয়া হয়ে পড়বে।

এই ভয়াবহ অবস্থার পরিবর্তন শুধু আইনের মাধ্যমে সম্ভব নয়; প্রয়োজন নৈতিক বিপ্লবের। সমাজে সততা, মানবতা ও সহমর্মিতা ফিরিয়ে আনার জন্য পরিবার ও শিক্ষাব্যবস্থাকেই হতে হবে সবচেয়ে শক্তিশালী ভিত্তি। শিশুদের ছোটবেলা থেকেই শেখাতে হবে যে সাফল্য মানে কেবল অর্থ নয়, মানবিক হওয়াই প্রকৃত সাফল্য। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নৈতিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা উচিত, যেন তরুণ প্রজন্ম প্রতিযোগিতার পাশাপাশি দায়িত্ববোধেও এগিয়ে থাকে। এছাড়া রাষ্ট্রকেও উদাহরণ স্থাপন করতে হবে সততা ও স্বচ্ছতার মাধ্যমে। যখন সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠিত হবে, তখনই সাধারণ মানুষও অনুপ্রাণিত হবে নৈতিকতায়।

মিডিয়া ও নাগরিক সমাজকে এই নৈতিক জাগরণে নেতৃত্ব দিতে হবে, যাতে লোভ নয়, সততাই হয় সামাজিক মর্যাদার মাপকাঠি। মানুষ সভ্যতার শুরু থেকে সুখ, নিরাপত্তা ও মর্যাদার জন্য সংগ্রাম করে এসেছে। কিন্তু আজকের তথাকথিত উন্নত সমাজে আমরা এমন এক অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছি, যেখানে নৈতিকতা আর মানবতা হারিয়ে যাচ্ছে লোভের অন্ধকারে। সমাজের প্রায় প্রতিটি স্তরেই—রাজনীতি, প্রশাসন, চিকিৎসা, শিক্ষা কিংবা বিচারব্যবস্থায় লোভ, অনৈতিকতা ও দুর্নীতির বিষাক্ত ছায়া ক্রমে বিস্তৃত হচ্ছে। এই বাস্তবতা শুধু অর্থনৈতিক সংকট নয়, এটি এক গভীর নৈতিক অবক্ষয়, যা জাতির আত্মাকে ক্ষয় করছে নিঃশব্দে।

লোভ কখনোই কেবল ব্যক্তিগত বিষয় নয়, এটি এক সামাজিক ব্যাধি। লোভ সমাজের বিবেক হত্যা করে, সত্যের কণ্ঠরোধ করে, মানবতাকে নির্বাসিত করে। আজ যদি আমরা এই লোভের আগুন নিভাতে না পারি, তবে একদিন এই আগুনই আমাদের সভ্যতাকে ছাই করে দেবে। মানুষকে আবার মানুষ হতে হবে—এটাই সময়ের দাবি। আমাদের ফিরতে হবে সেই সহজ সত্যে—‘মানুষের শ্রেষ্ঠ পরিচয় তার মানবতা।’ নৈতিকতার আলোয় উদ্ভাসিত সমাজই পারে এই অন্ধকার লোভের যুগ থেকে বেরিয়ে আসতে।

লেখক:

শিক্ষক ও কলামিস্ট