স্মার্টফোনের ফাঁদে সামাজিকতা॥ কাউছার খোকন

নিশ্চয়ই আপনি লক্ষ করেছেন, চারপাশে এত লোক, এত কোলাহল, এত সংযোগের সুযোগ থাকার পরও মনের গভীরে এক অপরিসীম ফাঁকা ভাব। রেস্তোরাঁয় একই টেবিলে বসেও সবাই নিজ নিজ ফোনের স্ক্রিনে মগ্ন। পারিবারিক আড্ডায় সরাসরি আলোচনার বদলে গ্রুপ চ্যাটের নোটিফিকেশন। উঠানে শিশুদের দৌড়ঝাঁপের বদলে স্মার্টফোনে গেমের আসক্তি। এগুলো এখন আর বিচ্ছিন্ন দৃশ্য নয়, এটাই আমাদের নতুন বাস্তবতা। স্মার্টফোন জীবনকে সহজ করলেও আমাদের সামাজিক বন্ধনের গাঁথুনিতে ফাটল ধরিয়েছে। এটি এখন আর শুধু একটি প্রযুক্তি পণ্য নয়, বরং সামাজিক অবক্ষয়ের একটি বড় হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে।

স্মার্টফোনের সবচেয়ে বড় বিদ্রূপ হলো, এটি আমাদের বিশ্বের সঙ্গে যুক্ত রাখে অথচ আমাদের চারপাশের মানুষগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। আমরা শত শত ফ্রেন্ড লিস্টে, অসংখ্য গ্রুপ চ্যাটে, সোশ্যাল মিডিয়ার ফলোয়ারে ভিড় করেও আশ্চর্য রকমভাবে একা বোধ করি। আগেকার দিনে প্রতিবেশীর বাড়িতে অকারণে ঢুকে পড়া, রাস্তায় পরিচিত মুখ দেখে দাঁড়িয়ে দীর্ঘ গল্প করা, আত্মীয়দের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া– এসব ছিল সামাজিক সম্পর্কের প্রাণকেন্দ্র। আজ সেসব জায়গা দখল করেছে একটি ফোনকল, একটি এসএমএস বা একটি ইমোজি রিঅ্যাকশন। আমরা ভাবছি, এতগুলো ‌‘লাইক’ আর ‘কমেন্ট’-এর মধ্যেই হয়তো সামাজিকতা সীমাবদ্ধ। কিন্তু এই ভার্চুয়াল সংযোগগুলো কখনোই একটি উষ্ণ কোলাকুলি, একটি সত্যিকারের হাসি বা একটি সহমর্মী আলিঙ্গনের বিকল্প হতে পারে না। আমরা ‘অনলাইন’-এ এতটাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছি যে, ‘অফলাইন’ জীবনের স্পর্শ, গন্ধ এবং আবেগকে ভুলতে বসেছি। এই যে প্রকৃত মানবিক সংযোগের অভাব, তা আমাদের মনে তৈরি করছে এক গভীর শূন্যতা, যার প্রকাশ ঘটছে মানসিক অশান্তি, হতাশা ও উদাসীনতা হিসেবে।

পরিবার হলো সামাজিক কাঠামোর মূল ভিত্তি। কিন্তু স্মার্টফোন সেই ভিত্তিতেই চিড় ধরিয়েছে। রাতের খাবারের টেবিল, যা একসময় পরিবারের সবার দিনলিপি বিনিময়ের কেন্দ্রবিন্দু ছিল, আজ সেখানে সবাই মোবাইলের স্ক্রিনে মশগুল। বাবা-মায়ের সঙ্গে সন্তানের কথোপকথন সীমিত হয়েছে জরুরি নির্দেশ বা প্রয়োজনীয় জিজ্ঞাসায়। সন্তানের আবেগ, ভয়, উত্তেজনা, স্বপ্নের কথা শোনার সময় আজকের বাবা-মায়ের হাতে নেই; কারণ সেই সময়টুকু কেড়ে নিয়েছে অফিসের ইমেল আর সোশ্যাল মিডিয়ার নোটিফিকেশন। দাদু-দাদি, নানা-নানির গল্প শোনার মতো ধৈর্য বা কৌতূহল আজকের তরুণ প্রজন্মের মাঝে অভাব দেখা দিয়েছে। ফলে প্রজন্মান্তরের মধ্যে তৈরি হচ্ছে এক অদৃশ্য দেয়াল, সম্পর্কগুলো হয়ে পড়ছে পৃষ্ঠোপলক্ষ্যমাত্র। আমরা একই ছাদের নিচে বাস করলেও মানসিকভাবে হয়ে পড়ছি একেবারেই আলাদা, যেন একই বাসায় বসবাসরত অচেনা মানুষ।

সামাজিক অবক্ষয়ের সবচেয়ে ভয়াবহ শিকার হচ্ছে আমাদের শিশু ও কিশোর-কিশোরীরা। যেসব হাসি-খেলায়, দৌড়াদৌড়িতে, বন্ধুদের সঙ্গে মারামারি, ঝগড়া-মীমাংসায় তাদের সামাজিক ও মানসিক বিকাশ হতো, তা আজ লোপ পেয়ে যাচ্ছে। একটি স্মার্টফোন বা ট্যাবলেট তাদের হাতে তুলে দিয়ে আমরা তাদের ‘বিজি’ রাখতে পারছি বটে, কিন্তু সেই ‘বিজি’ রাখার মূল্য দিতে হচ্ছে তাদের ভবিষ্যৎ দিয়ে। তারা বাস্তবজগতের খেলার মাঠ ছেড়ে ঢুকে পড়ছে ভার্চুয়ালজগতের অস্থির, অগভীর এবং অনেক সময় বিপজ্জনকজগতে। অনলাইন বুলিং, সাইবার হয়রানি, অপরিণত বয়সের অযাচিত কনটেন্ট তাদের কোমল মনে দাগ কাটছে। বাস্তব সম্পর্কের জটিলতা বোঝা এবং তাকে সামলানোর দক্ষতা তাদের অর্জনই হচ্ছে না। তারা হয়ে উঠছে খিটখিটে, অসহিষ্ণু, ধৈর্যহীন এবং সামাজিকভাবে অস্বস্তিকর। তাদের কল্পনাশক্তি ও সৃজনশীলতা ডুবে যাচ্ছে ইউটিউব ও ভিডিও গেমের সাগরে। এই প্রজন্মটি যদি বাস্তবতার বদলে স্ক্রিনের পিক্সেল নিয়েই বড় হয়, তবে ভবিষ্যতের সামাজিক কাঠামোটিই কীভাবে টিকবে, তা ভাবলেই শঙ্কা জাগে।

স্মার্টফোন ও সোশ্যাল মিডিয়ার চক্রে পড়ে আমাদের সামাজিক অনুভূতিগুলোও ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে যাচ্ছে। আমরা এখন কারও দুঃখে শোক প্রকাশ করি একটি 'স্যাড ইমোজি' দিয়ে, কারও সুখে অংশ নিই একটি ‘লাইক’ বাটন চেপে। কিন্তু প্রকৃত অর্থে কারও পাশে দাঁড়ানো, কারও কান্না মুছিয়ে দেওয়া, কারও সুখের মুহূর্তে উপস্থিত থেকে তা ভাগ করে নেওয়ার মতো মানবিক গুণাবলি আমরা হারিয়ে ফেলছি। আমরা ‘সেলফি’ তোলায়, নিজের জীবনকে চমৎকারভাবে উপস্থাপন করতে গিয়ে এতটাই মশগুল যে, অন্যদের ব্যথা-বেদনা, সুখ-দুঃখ আমাদের কাছে গৌণ হয়ে পড়ছে। এই আত্মকেন্দ্রিকতা আমাদের সমাজ নামকের সমষ্টিগত শরীর থেকে আলাদা করে ফেলছে।

এটি আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতির ওপরও আঘাত হেনেছে। বাংলা ভাষার সমৃদ্ধ শব্দভাণ্ডার, মার্জিত রীতি-নীতি আজ হুমকির মুখে। তার জায়গা দখল করছে ‘বিআরবি’, ‘এলওএল’, ‘এইচবিডি’-এর মতো সংক্ষিপ্ত রূপ, হিজিবিজি ইমোজি এবং ইংরেজি মিশ্রিত বিকৃত বাংলা। আমাদের লোকসংস্কৃতি, পালাপার্বণ, উৎসব-আনন্দ- এসবের প্রতি অনীহা বাড়ছে। পূজা, ঈদ, বড়দিনের আনন্দ এখন অনেকটাই ক্যামেরা বন্দি করে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। উৎসবের প্রকৃত অর্থ, তার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ আমরা ভুলে যাচ্ছি। আমাদের শিকড়ের সঙ্গে সম্পর্কটা হয়ে উঠছে ছবি তোলার একটা উপলক্ষ মাত্র।

প্রযুক্তি মানুষের জীবনকে সহজ করার জন্য আবিষ্কৃত হলেও এর অপব্যবহার মানুষ, সমাজ, জাতি তথা দেশকে বিপন্ন করতে পারে। যেমন—পানি সেচ করার পাম্প একটি প্রযুক্তি, যা দিয়ে ফসল উৎপাদন করা হয়। আবার গৃহস্থালি কাজে ব্যবহার্য দা দিয়েও কেউ কাউকে আহত করতে পারে। একইভাবে, তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার করে জ্ঞাননির্ভর অর্থনীতি গড়ে উঠেছে, যা চতুর্থ শিল্প বিপ্লব নামে পরিচিত। জ্ঞানের সমৃদ্ধি, সংরক্ষণ ও ব্যবহার তথ্য-প্রযুক্তির মাধ্যমে অবাধ ও সহজ হয়েছে। কিন্তু তথ্য-প্রযুক্তির সুবিধাটি যখন একজন অসৎ ও অপরাধপ্রবণ ব্যক্তির দ্বারা নেতিবাচকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে, তখনই এর অপব্যবহারে সমাজ বিপন্ন হয়ে পড়ছে।

এই অবস্থা থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ সচেতনতা ও সংযম। আমাদের বুঝতে হবে, স্মার্টফোন একটি সেবক, প্রভু নয়। আমাদের জীবনকে এর কাছে গচ্ছিত রাখলে চলবে না। এ বিষয়ে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি :

১. পরিবারে ‘ডিজিটাল-ফ্রি টাইম’ বাধ্যতামূলক করা: রাতের খাবার বা সন্ধ্যার কিছু সময় সম্পূর্ণরূপে ফোনমুক্ত রাখা। সেই সময়টুকু শুধু পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে গল্পগুজব, খেলাধুলা বা একসঙ্গে বই পড়ায় ব্যয় করা।

২. বাস্তব সম্পর্ককে প্রাধান্য দেওয়া: বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে ফোনে বা চ্যাটে নয়, যথাসম্ভব সরাসরি দেখা করার চেষ্টা করা।

৩. শিশুদের জন্য সীমাবদ্ধতা: শিশুদের স্মার্টফোন ব্যবহারের সময় সীমিত করা এবং তাদের জন্য বাস্তব বিশ্বের খেলাধুলা, বই পড়া ও সৃজনশীল কাজে উৎসাহিত করা।

৪. নিজের জন্য নিয়ন্ত্রণ: অপ্রয়োজনীয় নোটিফিকেশন বন্ধ রাখা, সোশ্যাল মিডিয়ায় সময়ের হিসাব রাখা এবং ডিজিটাল ডিটক্সের অনুশীলন করা।

স্মার্টফোন আমাদের জীবনে একটি বিপ্লব এনেছে, এতে সন্দেহ নেই। কিন্তু কোনো বিপ্লবই যখন সমাজ ও মানবতার মূল ভিত্তিকে নষ্ট করে, তখন তা অভিশাপে পরিণত হয়। আমরা যেন প্রযুক্তির এই ঝলমলে জগতের মোহে পড়ে আমাদের মানবিকতা, আমাদের সামাজিকতা, আমাদের হাসি-কান্না-ভালোবাসার বাস্তব জগতটিকে হারিয়ে না ফেলি। আমাদের মনে রাখতে হবে, একটি 'লাইক' কখনোই একটি সত্যিকারের স্পর্শের প্রতিস্থাপন হতে পারে না, একটি ইমোজি কখনোই একটি উষ্ণ হাসির সমান নয় এবং একটি স্ক্রিন কখনোই বন্ধুর কাঁধে হাত রাখার অনুভূতি দিতে পারে না।

আমাদের প্রযুক্তির সঙ্গে সহাবস্থান করতে শিখতে হবে, তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, নিজেদের এবং আগামী প্রজন্মকে একটি সুস্থ, সুন্দর ও সত্যিকারের ‘সামাজিক’ সমাজ উপহার দেওয়ার জন্য। নইলে আমরা হয়তো এমন এক ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি, যেখানে আমরা সবাই ‘সংযুক্ত’ থেকেও চরমভাবে ‘একা’। আমাদের সামাজিক অবক্ষয় রোধ করতে হবে এখনই, নতুবা ভবিষ্যৎ প্রজন্ম একটি নিঃসঙ্গ, যান্ত্রিক পৃথিবীর উত্তরাধিকারী হবে, যেখানে সম্পর্ক হবে পিক্সেলের খেলা, আর মানবতা হবে একটি অচল অ্যাপ।

লেখক:

সাংবাদিক ও কলামিস্ট