প্রতিটি জাতির সত্তার সঙ্গে মিশে আছে তার সংস্কৃতি। জাতির পরিচয় প্রতিফলিত হয় তার সংস্কৃতির মাধ্যমে। বাংলা জনপদের সংস্কৃতি পৃথিবীর যেকোনো জাতির সংস্কৃতি চেয়ে বেশি উন্নত। এই জনপদের সংস্কৃতিতে পাওয়া যায় উৎসবের মুখরতা। বাংলা জনপদের মানুষ সব সময় উৎসবে মেতে থাকে। তাই বলা হয়, ‘বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ’ একটি প্রবাদ, যা বাঙালির উৎসবপ্রিয়তা বোঝাতে ব্যবহৃত হয়, এর মাধ্যমে বোঝানো হয় যে সারা বছর ধরে নানা ধরনের উৎসব ও অনুষ্ঠান লেগে থাকে, যা কেবল সংখ্যায় তেরোটি নয়, আরও অনেক বেশি।
এই পার্বণগুলো কেবল ধর্মীয় উৎসবই নয়, বরং বিভিন্ন লোকায়িত এবং সামাজিক অনুষ্ঠানেও পরিপূর্ণ থাকে, যা বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বাংলা জনপদের উৎসবগুলোতে রয়েছে নানা বৈচিত্র্য, এই উৎসবগুলো নানা ধরনের হয়ে থাকে, যেমন- দুর্গাপূজা, কালীপূজা, লক্ষ্মীপূজা, ঈদ, পহেলা ফাল্গুন, চৈত্রসংক্রান্তি, নবান্ন, বর্ষা, শরৎ উৎসব, ভাইফোঁটা, দোলযাত্রা এবং বিভিন্ন পূজা-পার্বণ। এই উৎসবের সঙ্গে মিশে বিরাট তাৎপর্য তা হলো, বাঙালির উৎসবের প্রতি গভীর ভালোবাসা, সামাজিক বন্ধন এবং আনন্দ উদযাপনের মানসিকতা প্রকাশ করে।
উৎসবগুলো মানুষকে একত্রিত করে এবং একে অপরের সঙ্গে আনন্দ ভাগ করে নেওয়ার সুযোগ করে দেয়। বর্তমানে বাঙালিরা উৎসব পালনে পড়ছেন নানা বাধার মুখে। যার ফলে মনে হচ্ছে, বাঙালি কি তার সংস্কৃতির মূলধারাটি হারিয়ে ফেলবে। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ বকুলতলার ভেন্যুর অনুমতি বাতিল করায় ভেস্তে গেছে সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠীর ‘শরৎ উৎসব’। দীর্ঘ ১৯ বছর ধরে শরৎ উৎসবটি ঢাবির বকুলতলায় আয়োজন করে আসছিল এই শিল্পীগোষ্ঠী। এই শিল্পগোষ্ঠী নিয়ম অনুযায়ী বকুলতলা ভেন্যু হিসেবে ব্যবহার করার জন্য ২৬ হাজার টাকায় ভাড়া নেয়। তাদের অনুষ্ঠান করার জন্য অনুষদ কর্তৃপক্ষ লিখিত অনুমতিপত্রও দেয়।
সত্যেন সেন শিল্পগোষ্ঠীর আয়োজনটি ছিল শুক্রবার (১০ অক্টোবর) দিন সকাল সাড়ে ৭টায়। কিন্তু আগের দিন সন্ধ্যায় হঠাৎ করেই জানানো হয়, অনুষ্ঠানটি বকুলতলায় আয়োজন করা যাবে না। তারপর অনুষ্ঠান স্থগিত হওয়ার পর সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠী আয়োজনটি স্থানান্তর করে গেণ্ডারিয়ার কচি-কাঁচার মেলার মাঠে। সকাল থেকেই সেখানে প্রস্তুতি চলছিল। তবে রাত ৩টার দিকে গেণ্ডারিয়া থানার ওসি মোবাইল ফোনে কল দিয়ে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদককে জানান, এখানে অনুষ্ঠান করা যাবে না। সকালে মাঠে চেয়ার বিছানোর এক পর্যায়ে পুলিশ গিয়ে চেয়ার উঠিয়ে দেয়।
সত্যেন শিল্পগোষ্ঠী নিপীড়িত মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে সংস্কৃতির কাজটি করে। হাসিনার পতন আন্দোলনে এই গোষ্ঠীর ভূমিকা ছিল। সত্যেন সেন শিল্পগোষ্ঠীর মূল কার্যক্রমগুলোর মধ্যে আছে– ১. গণমানুষের অধিকার, স্বাধীনতা ও সাম্যের সমাজ গড়ার লক্ষ্যে সংস্কৃতি ও শিল্পের মাধ্যমে সংগ্রাম করা। ২. সমাজের গভীরে সুস্থ সাংস্কৃতিক ধারা প্রতিষ্ঠা করা এবং জনগণের মধ্যে ঐক্য গড়ে তোলা। ৩. মানুষের জন্য একটি মানবিক মর্যাদাসম্পন্ন সমাজ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন গড়ে তোলা। ৪. অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধ ধারণ ও প্রচার করে একটি অসাম্প্রদায়িক দেশ গঠনে কাজ করা। ৫. প্রতিষ্ঠার পর থেকে জনগণের মধ্যে স্বাধীনতার চেতনা ও মানবিক মূল্যবোধকে জাগ্রত করা। সত্যেন সেন শিল্পগোষ্ঠী বাংলা জনপদের মূল সংস্কৃতির ধারাটি লালন করে আসছে।
বাঙালি সংস্কৃতি বলতে সাধারণত বোঝানো হয় বিশেষ সমাজের সাহিত্য, সংগীত, ললিতকলা, ক্রীড়া, মানবিকতা, জ্ঞানের উৎকর্ষ ও আরও অনেক শান্তি ও সৌন্দর্যের সমাহার। এর পরও ব্যাপক দৃষ্টিতে দেখলে সংস্কৃতি হলো মানুষের জ্ঞান, আচার-আচরণ, বিশ্বাস, রীতিনীতি, নীতিবোধ, চিরাচরিত প্রথা, সমষ্টিগত মনোভাব, সামাজিক প্রতিষ্ঠান এবং অর্জিত কীর্তিগুলো। নৃতাত্ত্বিক দিক দিয়ে সংস্কৃতি আবার ভিন্ন ধরনের একটি জটিল ধারণা। যেহেতু সব সংস্কৃতিই উৎস, বিকাশ, মূল্যবোধ এবং সংগঠনের দিক দিয়ে বিশিষ্ট, তাই বাহ্যিক রূপরেখা, তার বিবিধ প্রকাশ এবং নির্যাসে এক সংস্কৃতি অন্য সংস্কৃতি থেকে যথেষ্ট পৃথক।
হাজার হাজার বছর ধরে নানা নৃতাত্ত্বিক এবং ধর্মীয় গোষ্ঠী ও শাখা-গোষ্ঠী, নানা শ্রেণির মিলন, পারস্পরিক প্রভাব এবং সমন্বয়ের ফলে গড়ে উঠেছে বাংলা জনপদের সংস্কৃতি। বহু শতাব্দী ধরে সংস্কৃতির বিভিন্ন, এমনকি, পরস্পরবিরোধী উপাদানের সহাবস্থান এবং সমন্বয়ের ফলে বাংলা অঞ্চলে বাঙালিত্বের এমন এক বৈশিষ্ট্য গড়ে উঠেছে, যাকে বলা যায় বাংলার সংস্কৃতি এবং এককথায় বলা যায় বাংলা জনপদ ও বাংলাভাষীদের সংস্কৃতি। তাছাড়া এভাবে বলা যায় যে, বাঙালি সংস্কৃতি বলতে বোঝায় একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর অর্থাৎ বাঙালিদের, জ্ঞান, বিশ্বাস, আচার-আচরণ, শিল্পকলা, সাহিত্য, সংগীত এবং জীবনযাপনের সামগ্রিক রূপ। এটি কোনো একক সংজ্ঞা দিয়ে সীমাবদ্ধ করা যায় না, কারণ এটি একটি বিশাল ও জটিল ধারণা, যা ঐতিহ্য, সামাজিক প্রথা, উৎসব এবং মানুষের সামগ্রিক জীবনযাত্রার মাধ্যমে প্রকাশিত হয়।
বাঙালি সংস্কৃতির উপাদানগুলো হচ্ছে– ১. এটি বাঙালি সমাজের জ্ঞান, বিশ্বাস, রীতিনীতি ও নীতিবোধের সমষ্টি। ২. এর মধ্যে রয়েছে সাহিত্য, সংগীত, ললিতকলা, এবং অন্যান্য নান্দনিক সৃষ্টি। ৩. উৎসব, যেমন- নবান্ন, বৈশাখী মেলা, একুশের বই মেলা এবং দোলযাত্রা এবং জীবনযাপনের প্রথা ও অনুষ্ঠানাদি এর অন্তর্ভুক্ত। ৪. এটি সমাজের বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠান এবং মানুষের সমষ্টিগত মনোভাবকেও অন্তর্ভুক্ত করে। ৫. বাংলা জনপদের সংস্কৃতির মধ্যে রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস ও ঐতিহ্য, যা লোকসংস্কৃতি, যেমন– বাউল গান, যাত্রা এবং ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ খেলাধুলা থেকে শুরু করে আধুনিক শহুরে জীবন পর্যন্ত বিস্তৃত। ৬. তাঁতের শাড়ি, জামদানি শাড়ি, শাড়িসহ , শীতল পাটি, ৭. সবচেয়ে বড় উপাদান বাংলা জনপদের সংস্কৃতিতে তা হলো- ভাষা, ধারণা ও বিশ্বাস, ইত্যাদির সমন্বয়। বর্তমানে ঘটে যাওয়া কিছু কর্মকাণ্ড লক্ষ করলে দেখা যায় যে, বাংলা জনপদের সংস্কৃতির খোলনলচে পাল্টিয়ে দেওয়ার একধরনের প্রক্রিয়া চলছে।
বাউল বাংলা সংস্কৃতির একটি অন্যতম অংশ। গত ২৫ সেপ্টেম্বর দৈনিক প্রথম আলো প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায যে, ময়মনসিংহ জেলায় একজন বাউলের জটা চুল কেটে দিয়েছে তিন ব্যক্তি। ময়মনসিংহ জেলার তারাকান্দা উপজেলার কাশীগঞ্জ বাজারে এই তিন ব্যক্তি কারা? ভিডিও দেখে শুধু আমরা এতটুকু জানতে পারছি, তারা পোশাক-আশাকে, চেহারা-সুরতে ইসলাম বেশধারী। সম্ভবত কোনো সংগঠনের হয়ে কাজ করেন। তবে দেখতে শক্ত-সামর্থ্যবান। তাদের সঙ্গে শক্তিতে কুলিয়ে উঠতে পারলেন না বয়স্ক বাউল। যেভাবে জোর করে ধরে তার চুল-দাড়ি কেটে দেওয়া হলো, সেই দৃশ্য কোনোভাবে মেনে নেওয়া যায় না।
ভুক্তভোগী মানুষটি বারবার বলছিলেন, ‘আল্লাহ তুই দেহিস।’ প্রকারান্তরে আল্লাহর কাছেই বিচার দিলেন তিনি। গরিবের আশ্রয়ের জায়গা তো ওই একটাই। কয়েক দিন আগে এমন আরও একটি ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছিল। যারা চুল কেটে দিচ্ছিলেন, তাদের কাছ থেকে বাঁচার জন্য ভুক্তভোগী লোকটি বলছিলেন, ‘চুল কাটছিস, দাড়িও কাটতে হবে।’ তখন তারা বলছিলেন, ‘তুমি তো নামাজ-কালামই পড়ো না, দাড়ি কাটলেই কি আর চুল কাটলেই কী। সেই ঘটনার শারীরিক ও মানসিক আঘাত এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেননি বৃদ্ধ বাউল হালিম উদ্দীন। বাইরে বের হতে অস্বস্তি বোধ করেন। তিনি মানসিকভাবে পর্যুদস্ত। বাংলা জনপদের নারীরা তাদের সংস্কৃতির ধারায় যে পোশাক-পরিচ্ছদ আছে তা পরিধান করবে– এটাই নিয়ম, তবে বর্তমানে এখানে আসছে নানা ধরনের বাধা। নারীরা তাদের নিজেদের ইচ্ছামতো পোশাক পরলে, রাস্তায় বের হলে পড়তে হচ্ছে ইভটিজিংয়ের মুখে, দৈনিক প্রথম আলো থেকে জানা যায় যে, সাংবাদিক ঝর্ণা রায় তার স্বামী ও পাঁচ বছর বয়সী মেয়েকে নিয়ে খাচ্ছিলেন। এক ব্যক্তি পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ‘মাথায় কাপড় না দিয়ে বেহায়ার মতো রাস্তার পাশে বসে খাচ্ছে, লজ্জা শরম নেই’ বলতে বলতে চলে যান।
ঝর্ণা রায় ফেসবুকের এক পোস্টে এ কথা উল্লেখ করে লিখেছেন, ‘মাথায় কাপড় না দেওয়ায় যা বললেন, তা না হয় আর না–ই বললাম। কী খাবো চোখ থেকে ঝরঝর করে জল গড়িয়ে পড়ছিল খাবারে।’
গত ২৯ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যার দিকে রাজধানীর ওয়ারীতে এ ঘটনা ঘটে। এই গণমাধ্যম থেকে আরও জানা যায় যে, গত ২১ সেপ্টেম্বর ধানমন্ডিতে মাদার কেয়ার হাসপাতালের সামনে পর্বতারোহী শায়লা বিথী হামলার শিকার হন। এ ঘটনায় শেরেবাংলা নগর থানায় লিখিত অভিযোগে তিনি বলেন, তিনি হাসপাতালটির সামনের পথচারী-সেতু থেকে নিচে নামার সময় এক ব্যক্তি পেছন থেকে হঠাৎ তার চুল মুঠি করে ধরে তাকে টেনে নিচে ফেলে মারধর করেন। তার কারণ তার মাথা হিজাব দিয়ে ঢাকা ছিল না।
১৪ অক্টোবরের দৈনিক ইত্তেফাক-এ প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, ‘ওড়না’ থাকা না থাকার প্রশ্ন তুলে এক তরুণীকে হেনস্তা করছেন কয়েকজন তরুণ- এমন একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। ৩৮ সেকেন্ডের ওই ভিডিওতে দেখা যায়, এক তরুণীকে ঘিরে মবের মতো পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে। কয়েকজন তরুণ তাকে আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে ঘিরে ধরে ‘ওড়না কোথায়’ বলে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন এবং আপত্তিকর অঙ্গভঙ্গি করছেন।
ভিডিওতে একাধিক তরুণ ওই তরুণীর প্রতি অশালীন আচরণ করেন এবং তার ধর্মীয় পরিচয় নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। তবে ভাইরাল ভিডিওটিতে ঘটনাস্থল, সময় কিংবা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের পরিচয় জানা যায়নি।
উপরোক্ত ঘটনাবলি বিশ্লেষণে বোঝা যায় যে, কিছু ব্যক্তি বাংলা জনপদের সংস্কৃতির ধারাটি ভিন্ন সংস্কৃতির বলয়ে নিয়ে যেতে চাচ্ছে। ধর্মের প্রলেপে এবং রাজনীতির মোড়কে বাংলা সংস্কৃতির বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগেছে কিছু মানুষ। একটা কথা সবারই মনে রাখা দরকার, মহান মুক্তিযুদ্ধ ছিল বাংলার সংস্কৃতি রক্ষার যুদ্ধ। তাই বাংলা জনপদের সংস্কৃতি রক্ষায় সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করাসহ যেকোনো চক্রান্তের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।
লেখক: কলামিস্ট
