প্রতিবছর বজ্রপাতে অনেক মানুষ প্রাণ হারান। বজ্রপাতের কবলে পড়ে সুস্থ স্বাভাবিক মানুষটিও মুহূর্তেই পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেন। একজন দু’জন নয়, প্রতিবছর গড়ে আমাদের দেশেই ৩০০ জনকে পৃথিবীর মায়া ছাড়তে হয় বজ্রপাতের কারণে। বাংলাদেশ সরকার ২০১৬ সালে বজ্রপাতকে একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
তবে এটি কি আসলেই দুর্যোগ নাকি অভিশাপ?
আবহাওয়া ও মহাকাশ বিশষজ্ঞরা বজ্রপাতের কারণ হিসেবে একাধিক কথা বলেছেন। একটি ব্যাখ্যা হলো- মেঘের ভেতরে বরফের টুকরোগুলোর উপর-নিচ ধাক্কার ফলে বৈদ্যুতিক চার্জ তৈরি হয়ে বজ্রপাত সৃষ্টি হয়। প্রক্রিয়াটা শুরু হয় ভূ-পৃষ্ঠ থেকে। ভূ-পৃষ্ঠের পানি যখন বাষ্প হয়ে উপরের দিকে উঠতে থাকে তখন মেঘের নিচের দিকে ভারী অংশের সাথে জলীয়বাষ্পের সংঘর্ষ হয়। এর ফলে অনেক জলকণা ইলেকট্রন ত্যাগকৃত হয়ে ধনাত্মক চার্জে পরিণত হয় এবং অনেক জলকণা সেই ইলেকট্রন গ্রহণ করে ঋণাত্মক চার্জে পরিণত হয়। এক পর্যায়ে চার্জিত জলীয় বাষ্পগুলো বিপুল পরিমাণ স্থির তড়িৎ শক্তি নিয়ে মেঘের টুকরোয় পরিণত হয়। মেঘের ভেতরে টুকরোগুলোর মধ্যে বিপরীতমুখী চার্জের পরিমাণ যথেষ্ট হলে ডিসচার্জ প্রক্রিয়া শুরু হয়। ফলে বৈদ্যুতিক স্পার্ক প্রবাহিত হয়। এই বৈদ্যুতিক স্পার্ক এর প্রবাহই মূলত বজ্রপাত। কিন্তু সব বজ্র পৃথিবীতে নেমে আসে না। আকাশ থেকে আকাশে বা মেঘ থেকে মেঘে অথবা মেঘের মধ্যেও বজ্রপাত হয়ে থাকে।
তবে কোরআন-হাদিসের বর্ণনানুযায়ী, বজ্রপাত মূলত আল্লাহ তাআলার শক্তির নিদর্শন। মহান আল্লাহর শক্তি ও ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করার কেউ নেই সেটাই প্রতিধ্বনিত হয় বজ্রপাতে। তাই বজ্রপাত বান্দার জন্য সতর্কবার্ত। একইসঙ্গে বজ্রপাতের মাধ্যমে আল্লাহ চাইলে শাস্তিও দিতে পারেন। আরও অবাক করা বিষয় হলো- যে বজ্রপাতের ভয়ে আমরা অস্থির থাকি, সেই বজ্রই মহান আল্লাহর তাসবিহ জপে, সাথে ফেরেশতারাও। যা থেকে বান্দার শিক্ষা নেওয়া উচিত।
বিষয়টি আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে কারিমে তুলে ধরেছেন এভাবে—‘তিনিই তোমাদেরকে দেখান বিজলি, ভয় ও আশা-আকাঙ্ক্ষারূপে এবং তিনিই সৃষ্টি করেন ভারী মেঘ। বজ্র তাঁরই তাসবিহ ও হামদ জ্ঞাপন করে এবং তাঁর ভয়ে ফেরেশতাগণও (তাসবিহরত রয়েছে)। তিনিই গর্জমান বিজলি পাঠান, তারপর যার ওপর ইচ্ছা একে বিপদরূপে পতিত করেন। আর তাদের (অর্থাৎ কাফিরদের) অবস্থা এই যে তারা আল্লাহ সম্পর্কেই তর্কবিতর্ক করছে, অথচ তাঁর শক্তি অতি প্রচণ্ড। (সুরা রাদ: ১২-১৩)
বলা হচ্ছে, আল্লাহর নাফরমানি থেকে বিরত না হলে, তিনি যে রাসুলের অনুসরণ করাকে বাধ্যতামূলক করেছেন, সেই রাসুলের বিরোধিতা করলে কেমন শাস্তি হতে পারে, সেই বার্তা বজ্র থেকেই বান্দা গ্রহণ করতে পারে। উপরোক্ত আয়াতটির শেষাংশে ‘আর তাদের (অর্থাৎ কাফিরদের) অবস্থা এই যে তারা আল্লাহর সম্পর্কেই তর্কবিতর্ক করছে, অথচ তার শক্তি অতি প্রচণ্ড’—এ কথার মাধ্যমে মহান আল্লাহ বান্দাদের সাবধান করে দিয়েছেন যে, তোমরা তো তাঁরই সৃষ্টি, কোন অহংকারে এবং কোন অধিকারে স্রষ্টার বিরোধিতায় মেতে ওঠো!
তাই বজ্রপাতকে কেবল অভিশাপ কিংবা দুর্যোগ না বলে একে আল্লাহর মহা শক্তির নির্দশন হিসেবেই গ্রহণ করা উচিত। তাঁর শাস্তির ভয়ে গুনাহের কাজ ত্যাগ করা ও আল্লাহর ইবাদতে নিমগ্ন হওয়া উচিত। পাশাপাশি এই দোয়া করা উচিত— اللَّهُمَّ لاَ تَقْتُلْنَا بِغَضَبِكَ وَلاَ تُهْلِكْنَا بِعَذَابِكَ وَعَافِنَا قَبْلَ ذَلِكَ ‘আল্লাহুম্মা লা তাকতুলনা বিগজাবিকা ওয়ালা তুহলিকনা বিআজাবিকা ওয়া আ-ফিনা কবলা জালিকা।’ অর্থ: ‘হে আল্লাহ! তোমার গজব দিয়ে আমাদের হত্যা করো না। তোমার আজাব দিয়ে আমাদের ধ্বংস করে দিও না। এর আগেই তুমি আমাদের নিরাপদে রাখ।’ (তিরমিজি: ৩৪৫০)
তবে, ঘুরেফিরে আল্লাহ তাআলা দয়াবান—এটাই সত্য। তাঁর শাস্তির চেয়েও রহমতের পরিমাণ বেশি। তাঁর দয়া প্রত্যেক সৃষ্টিকেই ঘিরে রেখেছে। তাই বজ্রপাতের সেই বিদ্যুতের চমকও অনেক সময় আশার বার্তা দিয়ে যায়। মনে একটা প্রশান্তির ঢেউ খেলে যায়। বিদ্যুতের চমকের একটু পরেই দেখা যায়, বৃষ্টি নেমে আসে। যে বৃষ্টির মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা মৃত ভূমিকে জীবন দান করেন। আল্লাহ তাআলা বলেন- ‘আর তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে তিনি তোমাদেরকে ভয় ও ভরসাস্বরূপ বিদ্যুৎ দেখান, আর আসমান থেকে পানি বর্ষণ করেন। অতঃপর তা দ্বারা জমিনকে তার মৃত্যুর পর পুনর্জীবিত করেন। নিশ্চয় এর মধ্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে সে কওমের জন্য যারা অনুধাবন করে। (সুরা রুম: ২৪)