মানুষকে আলো দেখিয়ে নিজেরাই অন্ধকারে

ইলম আল্লাহর পক্ষ থেকে দেওয়া এক মহামূল্যবান নূর। কিন্তু এই নূর যখন আমলের সঙ্গে যুক্ত না থাকে, তখন তা আলেমের জন্য বরং ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ইতিহাস-হাদিসে এমন আলেমদের কথা পাওয়া যায়, যারা মানুষের কাছে নসিহত করেন, সৎকাজে আহ্বান জানান, কিন্তু নিজেরাই সেই কাজ থেকে দূরে থাকেন। কোরআন ও হাদিসে এসব আমলহীন আলেমদের জন্য ভয়াবহ পরিণতির কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।

আল্লাহর ক্রোধ

পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে ঈমানদাররা! তোমরা এমন কথা কেন বলো, যা তোমরা করো না? আল্লাহর নিকট বড় ক্রোধের বিষয় এই যে, তোমরা বলো এমন কথা, যা তোমরা করো না।’ (সুরা সফ: ২-৩)

রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘ইসরার (মিরাজ) রাতে আমি এমন একশ্রেণির মানুষের কাছ দিয়ে গমন করলাম, যাদের জিহ্বাকে জাহান্নামের কাঁচি দিয়ে কাটা হচ্ছে। আমি জিবরাঈলকে (আ.) জিজ্ঞাসা করলাম, ওরা কারা? তিনি বললেন, এরা আপনার উম্মতের স্বার্থপূজারি উপদেশদাতা, যারা অন্যকে সৎ কাজের নির্দেশ দিত, কিন্তু নিজের খবর রাখত না।’ (মারেফুল কোরআন: ৩৭, মুসনাদে আহমদ: ১২২১১)

প্রদীপের মতো নিজেই আগুনে পুড়ে

রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি মানুষকে কল্যাণ শিক্ষা দেয়, কিন্তু নিজেকে ভুলে যায়, তার উদাহরণ হলো সেই প্রদীপের মতো, যা অন্যকে আলো দেয়, কিন্তু নিজেকে পুড়িয়ে ফেলে।’ (সহিহুত তারগিব ওয়াত তারহিব: ১৩১)

জাহান্নামের ভয়াবহ শাস্তি

ইবনে হারেসাহ (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘কেয়ামতের দিন এক ব্যক্তিকে আনা হবে। অতঃপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। সেখানে তার নাড়ি-ভুঁড়ি বের হয়ে যাবে এবং সে তার চারিপাশে এমনভাবে ঘুরতে থাকবে, যেমন গাধা তার চাকির চারিপাশে ঘুরতে থাকে। তখন জাহান্নামিরা তার কাছে একত্রিত হয়ে তাকে বলবে, ওহে অমুক! তোমার এ অবস্থা কেন? তুমি না (আমাদেরকে) সৎ কাজের আদেশ, আর অসৎ কাজে বাধা দান করতে? সে বলবে, অবশ্যই। আমি (তোমাদেরকে) সৎকাজের আদেশ দিতাম; কিন্তু আমি তা নিজে করতাম না এবং অসৎ কাজে বাধা দান করতাম; অথচ আমি নিজেই তা করতাম! (বুখারি: ৩২৬৭, ৭০৯৮; মুসলিম: ২৯৮৯)

কিতাববাহী গাধার মতো 

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘যাদেরকে তাওরাতের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল অতঃপর তারা তা পালন করেনি, তাদের উদাহরণ হলো সেই গাধার মতো, যে কিতাবের বোঝা বহন করে।’ (সুরা জুমা: ৫) এই আয়াতটি স্পষ্টভাবে নির্দেশ করে যে, ইলম যদি আমলে রূপান্তরিত না হয়, তবে তা কেবল বোঝাই হয়ে থাকে।

ইলমের নূর নিভে যাওয়ার আশঙ্কা

পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘তাদের দৃষ্টান্ত ওই ব্যক্তির ন্যায়, যে আগুন জ্বালালো। যখন তা চারদিক আলোকিত করল, আল্লাহ তাদের আলো নিভিয়ে দিলেন এবং তাদের অন্ধকারে রেখে দিলেন, তারা কিছুই দেখতে পায় না।’ (সুরা বাকারা: ১৭) আমলবিমুখ আলেমের অবস্থাও এমন, বাহ্যিকভাবে জ্ঞানী হলেও আত্মিকভাবে অন্ধকারে নিমজ্জিত।

ভুল উদ্দেশ্যে ইলম অর্জনের পরিণাম

রাসুল (স.) সতর্ক করেছেন, ‘যে ব্যক্তি আলেমদের সাথে তর্ক করার জন্য, মূর্খদের সাথে বিতণ্ডা করার জন্য অথবা মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য ইলম অর্জন করে, আল্লাহ তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন।’ (তিরমিজি, মেশকাত: ২২৫)

ইলম ও আমলের মধ্যে সমন্বয় ব্যতীত কোনো আলেমই প্রকৃত সফলতা অর্জন করতে পারেন না। জ্ঞানী ব্যক্তি যদি নিজের আমল বিসর্জন দেন, নিজেই নিজের ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের প্রত্যেকের উচিত নিজেদের আমল পরিশুদ্ধ করা এবং ইলমকে আমলে রূপান্তরিত করার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা করা। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে ইলমের হক আদায়কারী এবং আমলপরায়ণ বান্দা হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।