ব্যবধান কমছে বিএনপি-জামায়াতের!

বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটা লম্বা সময় ঘনিষ্ট সর্ম্পক ছিল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর। তবে ২০১৮ এর একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগ থেকে টানাপোড়েন শুরু হয় এই দুই দলের মধ্যে। সরকারবিরোধী আন্দোলনে থাকলেও দুই দল নিজস্ব আঙ্গিকেই কর্মসূচি পালন করেছে। কিন্তু দুই দলের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডে সম্পর্কোন্নয়নের ইঙ্গিত মিলছে। সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগও বেড়েছে, শুরু হয়েছে নতুন মেরুকরণ।

গত ২৭ মে রাত ৯টার দিকে বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে আম, লিচুসহ মৌসুমি ফল পাঠিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। এর আগে বিএনপির উদ্যোগে রাজনীতিকদের সম্মানে আয়োজিত ইফতার মাহফিলে জামায়াতের আমিরসহ চারজন কেন্দ্রীয় নেতারা অংশগ্রহণ করে। আবার জামায়াতে ইসলামীর ইফতার মাহফিলে বিএনপির একাধিক কেন্দ্রীয় নেতারা অংশগ্রহণ করেন।

অনেকের কাছে বিষয়টিকে দল দুটির ব্যবধান ঘোচানোর বার্তা হিসেবে দেখা হচ্ছে। দীর্ঘ বিরতির পর আবারও একমঞ্চে পাশাপাশি বসা রাজনীতিতে নতুন বার্তা বা ইঙ্গিত বলে মনে করছেন অনেকে। তবে দল দুটির মধ্যে সম্পর্ক যে খুব ঘনিষ্ঠ হয়েছে, তা মনে করছেন না নেতারা।

তবে জানা গেছে, সরকারের পদত্যাগ ও নতুন নির্বাচনের দাবির আন্দোলনে নিজেদের মধ্যে দূরত্ব ঘোচাতে চাইছে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী। রাজপথে আন্দোলন মাথায় রেখে দুই দলই সম্পর্কোন্নয়নের উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানা গেছে। ২০০১ সালে জামায়াতে ইসলামীসহ চারদলীয় জোট গঠন করে ক্ষমতায় এসেছিল বিএনপি। তবে দীর্ঘদিন থেকে জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক ভালো যাচ্ছিল না। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক নানা রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশে স্বাধীনতাযুদ্ধে বিরোধিতাকারী দল জামায়াতকে এড়িয়ে চলছিল বিএনপি।

বিভিন্ন সময়ে এই দুই দলের সঙ্গে নানা কারণে সম্পর্কের অবনতি হয়; কিন্তু সরকারবিরোধী আন্দোলনের প্রশ্নে ফের দুই দলের সম্পর্ক ঠিক হয়। সর্বশেষ উপজেলা পরিষদ নির্বাচন বর্জন করার সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি এবং সমমনা রাজনৈতিক দল ও জোট। এ নির্বাচনে প্রথমে জামায়াত অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও পরে সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে। 

সূত্রমতে, বিএনপির শীর্ষ নেতা জামায়াতের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলার পর উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে। এখন এই দুই দল আগের মতোই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখে চলছে বলে জানা গেছে।

রাজনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামী তার রাজনীতি টিকিয়ে রাখতে এখন মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির রাজনৈতিক শেল্টার চায়। এর পাশাপাশি বিএনপিসহ দলটির সাথে আন্দোলনরত অন্যান্য দলগুলোর মতো যুগপৎ আন্দোলনে শরিক হতে চায়। এ ব্যাপারে জামায়াত ইসলামী বিএনপির সাথে নিজেরাই দলটির বিভিন্ন চ্যানেলে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। গত কয়েকদিন আগে বিএনপির সঙ্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক জোট ও সমমনা দলের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে জামায়াতে ইসলামীকে সাথে নেওয়ার আলোচনা হয়।

এদিকে ১৮ মে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ৮ম জাতীয় সম্মেলনে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন বলেন, ‘দেশে স্বাধীনতাবিরোধীরা নির্মূল হবে, তাদের পদচিহ্নও থাকবে না’। তার এমন বক্তব্য নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে নানান আলোচনা শুরু হয়। এ নিয়ে জামায়াতে ইসলামীতেও নানান ধরনের অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। দেখা দিয়েছে বিভিন্ন প্রশ্ন। বলা হচ্ছে- তার এমন বক্তব্য আসলে কিসের ইঙ্গিত। ধারণা করা হচ্ছে- জামায়াতে ইসলামীর ওপরে কি নেমে আসছে আরও বড়ো ধরনের খড়গ? নেওয়া হচ্ছে- কঠোর পদক্ষেপ? সে পদক্ষেপের মাত্রা এ যাত্রায় হয়তোবা আরও ভয়ঙ্কর হতে পারে। 

কেননা, রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন বলেছেন, স্বাধীনতাবিরোধীরা সুযোগ পেলেই ছোবল মারতে চায়। কিন্তু এ দেশে স্বাধীনতাবিরোধীরা নির্মূল হবে, তাদের পদচিহ্নও থাকবে না। সেই অপশক্তিকে নিশ্চিহ্ন করতে যে প্রয়াস আমাদের প্রয়োজন, তা-ই করতে হবে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকমহল মনে করেন, একারণে জামায়াতে ইসলামী বেশ নড়ে চড়ে বসেছে। 

জানা গেছে, জামায়াতে ইসলামী দলটি বিএনপির হাই কমান্ডকে গত কয়েক মাস আগে বুঝিয়েছে যে তারা দলটির (বিএনপি) সাথে এক মঞ্চে আসলে সরকারের ভিত নড়ে যাবে। সরকার ক্ষমতা ছেড়ে চলে যাবে।

একটি সূত্র আরও জানায়, জামায়াতে ইসলামী মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের বিভিন্ন উদার প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল নাগরিক সমাজের থেকে বিএনপিকে দূরে সরিয়ে রাখতে ভূমিকা রাখতে দেখা গেছে। কিন্তু রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের বক্তব্যের পর জামায়াতে ইসলামী এখন নড়ে চড়ে বসেছে। পাল্টিয়েছে মত। তারা এখন যেভাবেই হোক বিএনপির সাথে এক মঞ্চে না হলেও যুগপৎ কর্মসূচিতেই থাকতে চায়। আর এ ব্যাপারে দলটি অতীতের চেয়ে আরও বেশি উঠে পড়ে লেগেছে-এমনটাই পাওয়া গেছে রাজনৈতিক বিভিন্ন সূত্র থেকে। 

বিএনপি চেয়ারপার্সন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার জন্য উপহার হিসেবে পাঠানো মৌসুমি ফল জামায়াতে ইসলামীর এমন রাজনীতিরই আভাস দেয়।

মৌসুমি ফল পাঠানোর বিষয়ে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল হালিম দৈনিক খবর সংযোগকে বলেন, জামায়াতে ইসলামীর আমির ড. শফিকুর রহমান বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার জন্য মৌসুমি ফল পাঠিয়েছেন। এটা কোনো রাজনৈতিক বিষয় না। আমরা জাতীয় স্বার্থে শুধু বিএনপি নয়, যেকোনো দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দলের সঙ্গেই ঘনিষ্ঠতা রাখতে চাই। 

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সমমনা রাজনৈতিক দল, জোটের সমন্বয়ক নজরুল ইসলাম খান দৈনিক খবর সংযোগকে বলেন, ফল পাঠানো কোনো রাজনীতি না। সাবেক প্রধানমন্ত্রী দেশনেত্রী অসুস্থ্য, বেগম খালেদা জিয়াকে যে কেহ ফল পাঠাতে পারেন। এতে দোষের কিছু না। শুধু জামায়াতে ইসলামীকে নয় গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনে সবাইকে পাশে চায় বিএনপি।