খান আতার একটি সিনেমা ‘আবার তোরা মানুষ হ’। কিন্তু সিনেমার মূল সুর কেউ ধরতে পারেনি। স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দি পেরিয়ে এসে আজও খান আতার সেই হতাশা বাংলাদেশকে ভোগাচ্ছে। যেখানে কৃত্রিম পর্যটন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে সিঙ্গাপুর এশিয়ার বৃহত্তর অর্থনীতির দেশ। সেখানে আমরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দেশ হয়েও পর্যটন থেকে উল্লেখযোগ্য আয় বঞ্চিত। যদিও আমাদের রয়েছে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্র সৈকত।
পাঁচ শতাধিক হকারের দখলে দেশের বৃহত্তম ১৫৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত। কাগজে-কলমে সৈকত এলাকায় হকারদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও বাস্তব চিত্র একেবারেই ভিন্ন। কোনো কোনো সময় পর্যটকদের চেয়ে হকারদের আনাগোনাই বেশি দেখা যায়। অনেক সময় হকারদের দৌরাত্ম্যে পর্যটকদের দুর্দশা বাড়ে।
ফলে অতিষ্ঠ হয়ে অনেকেরই এখানে বেড়াতে আসার স্বপ্নকে জলাঞ্জলি দিতে হচ্ছে। হকারদের উৎপাতে অতিষ্ঠ দেশি-বিদেশি পর্যটকরা। যদিও পর্যটকদের নিরাপত্তা ও পরিবেশ সুন্দর রাখার দায়িত্বে রয়েছে ট্যুরিস্ট পুলিশ। তবে তারা তাদের দায়িত্ব পালন না করে বেশিরভাগ সময়ই পর্যটকদের বিরক্তির কারণ হচ্ছেন।
কর্মরত এক শ্রেণির অসাধু পুলিশ সদস্যদের নিয়মিত চাঁদাবাজির কারণে হকারদের দৌরাত্ম্য দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। এতে করে একদিকে যেমন সৌন্দর্য ও পর্যটক হারাচ্ছে বিশ্বসেরা এ সমুদ্রসৈকতটি, তেমনি বড় অঙ্কের রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে দেশের পর্যটন খাত।
জানা গেছে, ভিক্ষুক থেকে শুরু করে চা, কফি, ডিম, চানাচুর, ঝালমুড়ি, বাদাম, কলা, ডাব, জুস, কোমল পানীয় বিক্রেতাদের হাঁকডাকে পর্যটকরা বিব্রত। এছাড়া রয়েছে গানবাজনা এবং শরীর ম্যাসেজ কারীদের অত্যাচার ও সীমাহীন দাপট। সৈকত এলাকার ছাতার নিচে চেয়ার বা চৌকিতে কেউ বসতে পারেন না। বসলেই এসব হকাররা তাদের ঘিরে ধরে। এক রকম বাধ্য হয়েই পর্যটকরা চেয়ার ছেড়ে অন্যত্র চলে যান। নারী পর্যটকদের উত্ত্যক্ত করা ও যৌন হয়রানির মতো ঘটনাও হর হামেশা ঘটছে। গত ১৮ ও ১৯ ফেব্রুয়ারি লাবণী, সুগন্ধা, ইনানী সৈকতসহ পুরো কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত ঘুরে এসব চিত্র পাওয়া গেছে।
সরেজমিন দেখা গেছে, সৈকতে অপরিচিত কোনো নারীর ছবি তোলার উপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। কিন্তু সেই নিষেধাজ্ঞা থোড়াই কেয়ার করছে এসব রোমিওর দল। বিধান রয়েছে সৈকতে কোনো ময়লা আবর্জনা ফেলা যাবে না। তারপরেও অবাধে এখানে যত্রতত্র ময়লা আবর্জনার স্তূপ গড়ে উঠেছে। ফলে ময়লার দুর্গন্ধে পর্যটকদের নাকে রুমাল দিয়ে চলাফেরা করতে হয়। যেখােেন সেখানে ফেলা হচ্ছে কলা ও ডাবের উচ্ছিষ্ট।
অভিযোগ রয়েছে, সৈকতে হকারদের নির্বিঘ্ন চলাফেরার নেপথ্যে রয়েছে কয়েকজন টুরিস্ট পুলিশ। আর পুলিশের কারণেই হকাররা এখন বেপরোয়া। পুলিশকে চাঁদা দিয়ে ৫০০-এর বেশি হকার পুরো সৈকত নিয়ন্ত্রণ করছে। এসব হকারদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ দেশি-বিদেশি পর্যটকরা। অনেকেই আতঙ্কে প্রতিবাদ করার সাহস পান না।
জানা গেছে, হকাররা ৩০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা দেন। চাঁদা না দিলে টুরিস্ট পুলিশের টহল গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সমুদ্রসৈকতে প্রতিদিন দেশি-বিদেশি বহু পর্যটক বেড়াতে যান। পর্যটকরা সমুদ্রপাড়ে গেলে তার পেছনে প্রথমে ক্যামেরাম্যান হাঁটতে শুরু করে। স্যার ছবি তুলবেন। আমার ক্যামেরায় ভালো ছবি ওঠে। ছবি তোলার পর কিছুক্ষণের মধ্যে ছবি দেয়া হবে। দাম পাঁচ টাকা থেকে প্রকারভেদে ছয় টাকা। আবার কেউ সৈকতে নেমে নানা কৌশলে ছবি তুললে তার জন্য বাড়তি টাকা দিতে হয়। এভাবে পর্যটকের পেছনে অর্ধশত ক্যামেরা ম্যান পিছু নেয়। এর পাশাপাশি কফি বিক্রেতা, বাদাম বিক্রেতা, ঝিনুকমালা বিক্রেতা, কলা বিক্রেতা, ঘোড়ায় চড়া, টায়ারে পানিতে ভাসা, স্পিড বোটে সমুদ্রে ঘুরা, মাথাম্যাসেজ করে দেয়া, গান শোনানো, ডিম বিক্রেতাসহ নানা পেশার প্রায় পাঁচশতাধিক হকার রয়েছে।
কক্সবাজার সুগন্ধা সৈকতে কথা হয় ক্যামেরাম্যান নুরুল আজিজের সঙ্গে। তিনি বলেন, সৈকতে ২০০-এর বেশি ক্যামেরাম্যান রয়েছে। আমরা প্রতিদিন টুরিস্ট পুলিশকে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা করে চাঁদা দিই। এভাবে ডিম, পানি, বাদাম, চা ও মুড়ি বিক্রেতাদের কাছ থেকেও পুলিশ চাঁদা আদায় করে।
শিশু হকার রাবেয়া, তৈয়বা, বসির, মুন্নিরা জানায়, সৈকতে পুলিশ তাদের কাছ থেকে দিনে ২০ টাকা করে চাঁদা নেয়। না দিলে গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়। তাই তারা পুলিশকে ২০ টাকাচাঁদা দিয়ে সৈকতে পণ্য বিক্রি করে। তাদের মতে, পুলিশকে টাকা না দিলে তারা সৈকতে ঢুকতে দেয় না। ঘোড়ার শরীরে হাত দিয়ে ছবি তোলা নিয়ে মাঝে মধ্যেপর্যটক ও ঘোড়ার মালিকদের মধ্যে কথাকাটাকাটি হয়। অনেক ঘোড়া চালক শুধু ঘোড়ার শরীরে হাত দেয়ার জন্য ১০ টাকা দাবি করলে পর্যটক ছবি প্রতি পাঁচ টাকা দিতে চাইলে খারাপ আচরণ করতে দেখা গেছে।
এ সম্পর্কে আবুল কালাম নামে এক টুরিস্ট পুলিশের কাছে জানতে চাইলে তিনি টাকা নেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, তাদের দায়িত্ব পর্যটকদের নিরাপত্তা দেওয়া। পর্যটকরা সৈকতে বেড়াতে এসে যা কিছু করবে তা তাদের ব্যাপার। টাকা নিয়ে হকার বসানোর বিষয়টি তার জানা নেই বলে জানান। জেলা পুলিশের বিষয়টি জানা নেই। তবে তার নামটি না দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন।
সুগন্ধা সৈকতে ঢুকতেই হাতের বাম পাশে সৈকত কর্তৃপক্ষের বিজ্ঞপ্তি টানানো আছে। সেখানে লেখা আছে ‘ সৈকত এলাকায় হকার নিষিদ্ধ।’ কিন্তু বিজ্ঞপ্তির নিচে বসেই এক হকার ওজন মাপার একটি ডিজিটাল মেশিন বসিয়ে ওজন মাপছে পর্যটকদের।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পর্যটক আক্ষেপ করে বলেন, কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে গিয়ে কোনো পর্যটক যদি টুরিস্ট পুলিশ খুঁজতে যান তবে অমাবশ্যার রাতে জ্যোৎস্না খোঁজার মতোই অবস্থা হবে। আর যদি কেউ মনে করেন, সৈকতে টুরিস্ট পুলিশ নিরাপত্তা দেবে, তবে ধরেই নিতে হবে তিনি এখনও বোকার স্বর্গে বসবাস করছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সুনির্দিষ্ট কোনো দিকনির্দেশনা না থাকায় কক্সবাজারে পর্যটকরা পদে পদে হয়রানির শিকার হন। নির্দিষ্ট স্থান খুঁজে পেতে পথচারীকে জিজ্ঞাসা করতে হয়। তাদের অনেকের নির্দেশনা অনুযায়ী পর্যটকরা ভুল পথে গিয়ে বিপদে পড়েন বলেও জানা গেছে।
কক্সবাজার রিজিয়ন ট্যুরিস্ট পুলিশ স্টেশনে গেলে গেইটম্যান বলেন, সাব ইন্সপেক্টর সোলাইমান এর সঙ্গে কথা বলেন, তিনি বলেন, আমি নতুন এসেছি। আপনি দ্বিতীয় তলায় গিয়ে সাব ইন্সপেক্টর মো. সুমন মিয়ার সঙ্গে কথা বলতে বলেন। দ্বিতীয় তলায় গিয়ে সমুন মিয়ার সঙ্গে কথা বলা যায়নি। সেখান থেকে জানানো হয় ডিআইজি আপেল মাহমুদ এর কাছে যান তিনিই সব বলতে পারবেন।
কক্সবাজার রিজিয়ন ট্যুরিস্ট পুলিশ এর ডিআইজি আপেল মাহমুদের অফিস কার্যালয়ে গিয়েও তার দেখা পাওয়া যায়নি। তার অফিস সহকারী বলেন, স্যার আসেন নাই। তবে তার মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলেও তিনি কোন সাড়া দেন না।
এদিকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, টুরিস্ট পুলিশ থাকার কথা ৮২ জন, সেখানে রয়েছে ৪০ জন। এর মধ্যে ট্রাফিক, রাজনৈতিক সভাসমাবেশ ও রাষ্ট্রীয় কোনো অনুষ্ঠানে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালনের জন্য দেওয়া হয়। এসব কারণে পর্যটন এলাকায় টুরিস্ট পুলিশের সংখ্যা খুবই নগণ্য।