মুড়ির টিন। হঠাৎ মনে হবে মুড়ি রাখার পাত্র। না, এটি একটি গণপরিবহনের নাম। বাসের নাম ‘মুড়ির টিন’ শুনতে একটু অদ্ভুত শোনালেও এই নামকরণের কারণ আছে। সেসময়ের বাসগুলোর দেহকাঠামো ছিল কাঠের। আর এই কাঠের কাঠামোকে টিন দিয়ে মুড়িয়ে দেওয়া হতো। দেখতে অনেকটা মুড়ি রাখার টিনের মতো লাগতো বলে লোকমুখে এই বাসের নাম হয়ে যায় ‘মুড়ির টিন’।
এক সময় ঢাকার রাস্তাজুড়ে চলাচলকারী মুড়ির টিন এখন আর চোখে পড়ে না। সময়ের অমোঘ নিয়মে তা এখন কেবলই স্মৃতি, ইতিহাসের পাতায় ধুলোমাখা একটি অধ্যায়। তার সেই জায়গা দখল করে নিয়েছে ঝলমলে এয়ারকন্ডিশন্ড ও আধুনিক বাসের বহর। কিন্তু যারা দেখেছেন, তাদের কাছে ‘মুড়ির টিন’ শুধু একটি বাস নয়; এক টুকরো নস্টালজিয়া।
এই বাসগুলো চলেছে মূলত সত্তর ও আশির দশকে। সেসময় ঘোড়ার গাড়ি বা গরুর গাড়ি থাকলেও সাধারণ মানুষের চলাচলের প্রধান বাহন ছিল এই মুড়ির টিন বাস। বাসের চারপাশে কাঠের বেঞ্চ থাকতো, যাতে বসতে পারতেন ২০ থেকে ২২ জন যাত্রী। আর মাঝের ফাঁকা জায়গায় ৪০ থেকে ৫০ জন দাঁড়িয়ে যেতে পারতেন। বাসের সামনের সিটগুলো থাকতো নারী যাত্রীদের জন্য সংরক্ষিত। সেই বাসের পেছনের দিকে বসার মজাই ছিল আলাদা।
কাঠের বডির ওপর টিনের ছাউনি দেওয়া হতো; এতে এদিকে বৃষ্টিতে যাত্রীরা ভিজতো না, অন্যদিকে তীব্র রোদে তাপও সরাসরি লাগতো না। ব্রিটিশ আমলের সেই বাসগুলোতে জানালায় কাঁচ থাকতো না। বাস চালু করতে তখন হ্যান্ডেল ঘুরাতে হতো। পরে চাবি লাগানো হয়। সেসময় বাসের গতি ছিল খুবই কম, ঘণ্টায় ১৫ থেকে ২৫ কিলোমিটার। কন্ডাক্টরের কাঁধে থাকত লম্বা ফিতাওয়ালা চামড়ার ব্যাগ, যেখানে টাকা ও টিকিট রাখা হতো।
শুরুতে এই বাসগুলো চলাচল করত সদরঘাট, নবাবপুর, ইসলামপুর, চকবাজার ও গুলিস্তান এলাকায়। পরে এগুলো নারায়ণগঞ্জ, মিরপুর, ডেমরা ও রামপুরা রুটেও চলাচল শুরু করে। গুলিস্তান থেকে কালিয়াকৈর, নয়ারহাট ও আরিচা পর্যন্তও চলত লম্বা ধরনের মুড়ির টিন বাস।
মুড়ির টিন বাসের শুরুটা হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর। যুদ্ধ শেষে মিত্রবাহিনীর ব্যবহৃত ট্রাক, জিপ ইত্যাদি গাড়ি স্থানীয় বিত্তশালীদের কাছে বিক্রি করা হয়। আজিম বখশের বাবা মওলা বখশ সরদারসহ অনেকে এসব গাড়ি মেরামত করে বাসে রূপান্তর করেন। পরে বাসের ইঞ্জিন আনা হতো বিদেশ থেকে।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন হয়েছে গণপরিবহন ব্যবস্থার। ২৫ বছরের পুরনো গাড়ি বাতিলের নিয়ম করায় আশির দশকের পরই ঢাকা থেকে মুড়ির টিন বাস প্রায় উঠেই যায়। এখন সেগুলোর জায়গায় চলছে আধুনিক ডিজেল ও সিএনজি চালিত বাস, এমনকি এসি বাসও।
প্রযুক্তির উৎকর্ষে পুরনোকে বিদায় দিয়ে নতুনের আবির্ভাব হয়, এটাই সময়ের স্বাভাবিক গতি। কিন্তু ‘মুড়ির টিন’ বাসে চড়েছেন যারা, ঢাকার সেই পুরনো দিনের স্মৃতি তাদের হৃদয়ে চিরকাল অম্লান হয়ে থাকবে। এটি ছিল একটি যুগের, একটি শহরের বেড়ে ওঠার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও স্মৃতিময় অধ্যায়।