কারখানার মতো একপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বড় বড় কন্টেইনার। অন্যপাশে রয়েছে বড় বড় নির্মাণসামগ্রী। মধ্যখানে রয়েছে ময়লা আবর্জনা। আগের মতো নেই কোনো সবুজের সমারোহ। নেই নানান শ্রেণি-পেশার মানুষের কোলাহল। সকাল হলে দেখা যায় না কাউকে শরীর চর্চায় দৌড়াচ্ছে। বিকালে আর বসে না তরুণদের আড্ডা। কিশোরদের দেখা যায় না খেলাধুলায়। প্রতিদিন বিকেলে বাবার হাত ধরে হাঁটতে আসে না শিশুরা। আগে যেখানে রোজ সকালে পাখিদের কিচির-মিচিরের শব্দ শোনা যেত এখন সেটা কেবলই অতীত।
বলছি, রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত ফার্মগেটের ঐতিহাসিক শহীদ আনোয়ারা উদ্যানের কথা। আজ থেকে প্রায় ৫৫ বছর আগে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের প্রথম নারী শহীদ আনোয়ারা বেগমের সম্মানে তাঁর স্মৃতি রক্ষার্থেই রাজধানীর ফার্মগেটের এ উদ্যানের নামকরণ করা হয়।
সরেজমিন দেখা যায়, ফার্মগেটের এই উদ্যানের চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বড় বড় কন্টেইনারসহ মেট্রোরেল প্রকল্পের বিভিন্ন নির্মাণসামগ্রী ও সরঞ্জাম। আগে যেখানে ছিলো ছিল সবুজের সমারোহ এখন সেখানে ইট পাথরের ভবন।
জানা যায়, ফার্মগেটে শহীদ আনোয়ারা উদ্যানের এই জায়গাটি গণপূর্ত অধিদপ্তরের অধীনে। এটির রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়নের দায়িত্ব ছিল ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি)। তবে গণপূর্ত অধিদপ্তরের অনুমতি নিয়ে ২০১৮ সাল থেকে সেখানে মেট্রোরেলের প্রকল্প অফিস ও নির্মাণ উপকরণ রাখার কাজে ব্যবহার করছে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)। মেট্রোরেলের নির্মাণ কাজ শেষে এই উদ্যান ফিরিয়ে দেওয়ার কথা থাকলেও দখল না ছেড়ে এখন সেখানে বিপণিবিতান, রেস্টুরেন্ট, বিনোদনকেন্দ্রের মতো বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ। ফলে দিন দিন উদ্যান রক্ষার আন্দোলনের তাপ বাড়ছে।
একটা সময় ঐতিহাসিক এই উদ্যানই ছিল ফার্মগেট, রাজাবাজার, তেজতুরি বাজার, মনিপুরিপাড়া, তেজকুনিপাড়াসহ আশপাশের এলাকার বাসিন্দাদের বিনোদন, খেলাধুলা ও হাঁটার জন্য উন্মুক্তস্থান হিসেবে শেষ ভরসা। সবুজের সমারোহ গাছপালা কেটে সেখানে নিজেদের ব্যবসার পরিকল্পনার সিদ্ধান্ত নেয়ায় এলাকাবাসীর মধ্যে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। ফলে সামাজিকভাবে গঠন করা হয়েছে ‘শহীদ আনোয়ারা উদ্যান রক্ষা আন্দোলন’ নামে সংগঠন।
সুয়েব আহমদ নামে স্থানীয় এক যুবক দৈনিক খবর সংযোগকে বলেন, এই উদ্যান ঘিরে কত স্মৃতি রয়েছে তা বলে বুঝানো সম্ভব না। আমার শৈশব বলতে এই উদ্যান। একটা সময় ছিলো যখন মন খারাপ থাকতো তখন এই উদ্যানে আসলে প্রাকৃতিক পরিবেশ দেখে মন ভালো হয়ে যেত। কত খেলাধূলা যে করেছি এই পার্কটিতে তা এখন অতীত। আমরা চাই মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষের যেন শুভ বুদ্ধির উদয় হয়।
আরিফুজ্জামান নামে আরেক ব্যক্তি দৈনিক খবর সংযোগকে বলেন, অবসর সময়ে এখানে এসে বসে থাকতাম। খুব ভালো লাগতো। রোজ সকালে শরীরচর্চা করতাম। বিকাল হলে দেখতাম কত মানুষের আনাগোনা ছিলো এই উদ্যান ঘিরে। তাছাড়া এটি ছিলো পাখিদের অভয়াশ্রম। কত বছর হয়ে গেলো পাখিদের কিচির-মিচির শুনি না।
এ সময় তিনি আরও বলেন, শুনেছি মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ না কি এখানে স্টেশন প্লাজা নির্মাণ করবে। আর যদি তাই হয় তাহলে আমরা কঠোর আন্দেলনে যাবো এই উদ্যানটি রক্ষায়। আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে জোর আবেদন করি প্রাকৃতিক-পরিবেশ ও ঢাকার আবহাওয়ার বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় যেন তিনি এলাকার মানুষের মতামতকে গুরুত্ব দেন।
সাইফুল ইসলাম নামে স্থানীয় এক ব্যক্তি দৈনিক খবর সংযোগকে বলেন, এটি ঐতিহাসিক একটি স্থান। দেশের ইতিহাস মুছে উন্নয়নের নামে ব্যবসায়িক চিন্তা ভাবনা আমরা সফল হতে দিব না। আমরা প্রয়োজনে রাস্তায় নামবো এই উদ্যান রক্ষার আন্দোলনে। তবে আমরা চাই মেট্রোরেলের কর্তারা যেন তাদের এমন অযৌক্তিক চিন্তা বিরত থাকে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক আলমগীর কবির দৈনিক খবর সংযোগকে বলেন, মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ যা করছে তা একদম ঠিক করছে না। তারা প্রকল্প নির্মাণের জন্য আনোয়ারা উদ্যানটি ফিরিয়ে দেয়ার শর্তে সাময়িকভাবে ব্যবহারের অনুমতি নিয়ে এখন যে টাল বাহানা করছে তা দেশের বন রক্ষা আইনের পরিপন্থি। এই শহরে সবুজ গাছপালা ধ্বংস করে যেভাবে ইট পাথরের স্থাপনা নির্মাণ করা হচ্ছে তা দুঃখজনক।
এ সময় তিনি আরও বলেন, শুধু আনোয়ারা উদ্যান নয়, এই দেশের যত গাছপালা জলধারা রয়েছে, তা যদি কেউ ধ্বংস করতে চায় আমরা তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাবো।
ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) মো. আব্দুল বাকী মিয়া দৈনিক খবর সংযোগকে বলেন, মানুষ গুজব রটাচ্ছে। এখানে আমরা ব্যবসায়িক কোনো কিছুই নির্মাণ করবো না। মানুষজন শুধু গুজব রটাচ্ছে। এটা পার্কই থাকবে । তবে এটি আরও উন্নত করা হবে।
এ সময় তিনি আরও বলেন, আপনারাও মানুষদের বুঝান। এটি বলেন যে বর্তমান কাজের মেয়াদ আরো দেড় বছর বাকি আছে। এখনও কোনো পরিকল্পনা আমরা হাতে নেইনি। দেড় বছর শেষ হওয়ার পর আমরা পরিকল্পনা করবো এখানে কিভাবে উন্নত পার্ক করা যায়।
এদিকে গত শনিবার (১৮ মে) শহীদ আনোয়ারা উদ্যান দখলমুক্ত ও বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ বন্ধ এবং উদ্যানকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দেওয়ার দাবিতে সমাবেশ করেছেন বিভিন্ন সংগঠন ও শ্রেণি-পেশার মানুষজন।
উল্লেখ্য, এর আগে গত বছর অক্টোবর মাসে ফার্মগেট ফুট ওভারব্রিজ উদ্বোধনের সময় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল উদ্যানটি উদ্ধারের প্রতিশ্রুতি দেন।
