‘ব্যাংক খাতে নীতি তৈরি হচ্ছে দুর্নীতির প্রয়োজনে’

দেশের অর্থনৈতিক সংকট ক্রমেই জটিল হলেও এই অবস্থা থেকে উত্তরণে রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঠিক পদক্ষেপ নেই। দেশে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা ব্যাংক খাতে। ব্যাংক খাতে কীভাবে দুর্নীতি করা যায়, সেটা মাথায় রেখেই নিয়মনীতি করা হচ্ছে।

রাজধানীর ব্র্যাক ইন সেন্টারে শনিবার (৪ মে) ঢাকা ফোরাম আয়োজিত ‘রাজনীতি অর্থনীতি: বাংলাদেশ এখন’ শীর্ষক সেমিনারে এসব কথা বলেন বক্তারা। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন।

অর্থনীতিবিদ ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, দেশে সার্বিক জবাবদিহিতে ধস নেমেছে। দুর্নীতিটা সিস্টেমেটিক পর্যায়ে চলে গেছে। ধরা পড়েছে, কিন্তু কিছু হচ্ছে না। ব্যাংকিং খাতের দুর্নীতি নিয়ে তিনি আরও বলেন, আগে দুর্নীতি বলতাম টাকা নেওয়াটা। এখন নীতি তৈরি হচ্ছে দুর্নীতির প্রয়োজনে। তবে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী একটা দক্ষতা দেখাচ্ছে বলে মন্তব্য করে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, খাদে যেন না পড়ে যায়, সেটার জন্য ব্যবস্থা নিচ্ছে। রিজার্ভে ধস নেমে যাচ্ছিল। তারা আমদানি নিয়ন্ত্রণ করে এটাকে বাঁচিয়েছে।

দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে অত্যন্ত জটিল আখ্যায়িত করে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের ফেলো অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, মূল্যস্ফীতির সঙ্গে এই এক বছরে আরও দুটি নতুন উপসর্গ যোগ হয়েছে। প্রথমটি হলো দায়দেনা পরিস্থিতির ঝুঁকি। অপরটি প্রবৃদ্ধির ধারা স্লথ হয়ে যাওয়া। দায়দেনার পরিস্থিতি এখন আরও জটিল হয়েছে। এটা ক্রমান্বয়ে বাড়বে। এটা যে শুধু রাজস্বের ওপর চাপ তৈরি করছে তা নয়, এটা বিনিময় হারের ওপরও চাপ তৈরি করছে। বৈদেশিক মুদ্রার মজুত আরও কমিয়ে দিচ্ছে।

অর্থনীতির সার্বিক এই পরিস্থিতির জন্য রাজনৈতিক জবাবদিহি ও স্বচ্ছতার অভাবকে দায়ী করে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য আরও বলেন, নাগরিকের বদলে নতুন একশ্রেণির স্বার্থসংশ্লিষ্ট গোষ্ঠী, ব্যক্তি ও পরিবারে জন্ম হয়েছে। এরা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে একধরনের কুপ্রভাব তৈরি করেছে। এ কুপ্রভাবের কারণ হলো, তাদের মোকাবিলা করার জন্য যে রাজনৈতিক শক্তি, গণতান্ত্রিকতা ও জবাবদিহির দরকার পড়ে, সেটা অনুপস্থিত।

এই পরিস্থিতির দায় শুধু বর্তমান সরকার ও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠীতন্ত্রের ওপর না দিয়ে নাগরিক সমাজ, উৎপাদক শ্রেণির পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি হিসেবে বিকল্প রাজনৈতিক শক্তির ওপর দেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। বিএনপিকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, আপনারা মূল্যস্ফীতিকে কীভাবে বের করে নিয়ে আসবেন? ব্যাংকিং খাতে যে সংকট, সরকার করতে গিয়েও পারছে না, মার্জার করতে যেয়েও হচ্ছে না, সুদের হার ঠিক করতে পারে না। কিন্তু আপনি কি পারবেন?

দলটিকে উদ্দেশ করে দেবপ্রিয় আরও বলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত বিকল্প কিছু না দিতে পারবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত জনগণ আপনার পক্ষে রাস্তায় নামবে না। জনগণ আগের চেয়ে বেশি সচেতন। এসময় বিএনপির বারবার নির্বাচন বর্জন করারও সমালোচনা করেন দেবপ্রিয়।

যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভর্সিটির অধ্যাপক ড. আলী রিয়াজ বলেন, পলিটিক্যাল এলিটরা এখন খুবই ছোট। তাদের আবার নির্ভর করতে হয় একজন ব্যক্তির ওপর। তার ইচ্ছা-অনিচ্ছার সঙ্গে কোনোরকম অসংগতি যদি তৈরি হয়, তাহলে তাদেরকে ছিটকে পড়তে হয়। আমরা অতীতে এবং বিভিন্ন দেশে দেখেছি যে ব্যক্তিকেন্দ্রিক শাসনে যখন পলিটিক্যাল এলিটের সংখ্যা কমে যায় এবং শুধুমাত্র শক্তি প্রয়োগকারী বাহিনীর ওপর নির্ভর করে, তখন এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি হয় যে সেটা ভেঙে পড়তে পারে।

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আমাদের এখানে সমস্যা হলো, বুদ্ধিজীবীরা ছোটখাটো জিনিস নিয়ে অনেক আলোচনা করেন। ব্লু ইকোনমি থেকে বিলিয়ন ডলার আসবে বাংলাদেশে। ব্লু ইকোনমিতে যে রাজনীতি আছে, সেগুলো কিন্তু আমরা ভুলে যাই। অনেক আলোচনা করি, কিন্তু গভীর আলোচনা না করেই আমরা চট করে লুফে নিই।

সেমিনারে আরো বক্তব্য দেন সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার, টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, সাবেক ব্যাংকার আবু নাসের বখতিয়ার প্রমুখ।