নির্ধারিত দামে নেই পণ্য, বিপাকে ভোক্তারা

সরকারের নির্ধারিত তালিকা অনুযায়ী নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম নির্ধারণ করা হলেও বাস্তব বাজারে তার কোনো প্রতিফলন মিলছে না। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) নিয়মিতভাবে নিত্যপণ্যের মূল্য তালিকা প্রকাশ করলেও রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন কাঁচাবাজারে সেই তালিকার সঙ্গে মিল নেই। এতে সাধারণ ভোক্তাদের নাভিশ্বাস উঠে গেছে।

শুক্রবার (১৯ সেপ্টেম্বর) সকালে রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে এমন চিত্র। বাজার বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, টিসিবির তালিকায় দেশি পেঁয়াজের দাম ছিল কেজিপ্রতি ৭৫ থেকে ৮০ টাকা, অথচ বাজারে তা পাওয়া যাচ্ছে ৮০ থেকে ৯০ টাকায়। ফার্মের মুরগির ডিমের দাম ডজনপ্রতি নির্ধারিত হয়েছিল ১৩৫ থেকে ১৪৫ টাকা, কিন্তু বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১৪৫ থেকে ১৫০ টাকায়। দেশি মসুর ডালের দাম তালিকায় ছিল ১৬০ থেকে ১৭০ টাকা, বাস্তবে তা পাওয়া যাচ্ছে ১৮০ টাকায়। করলা নির্ধারিত ছিল ১০০ থেকে ১২০ টাকা, কিন্তু বিক্রি হচ্ছে ১৩০ থেকে ১৪০ টাকায়। ঢেঁড়স ও পটোল নির্ধারিত ছিল ৮০ থেকে ৯০ টাকা, বাজারে পাওয়া যাচ্ছে ১০০ টাকায়। বরবটির দাম তালিকায় ছিল ১০০ থেকে ১১০ টাকা, বাস্তবে মিলছে ১২০ টাকায়। 

এদিকে শসার নির্ধারিত দাম ছিল ৮০ টাকা, কিন্তু বাজারে পাওয়া যাচ্ছে ১০০ টাকায়। ঝিঙার দাম তালিকায় ছিল ৮০ থেকে ৯০ টাকা, বাস্তবে পাওয়া যাচ্ছে ১০০ থেকে ১২০ টাকায়। দুন্দলের দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল ৯০ থেকে ১০০ টাকা, অথচ বাজারে মিলছে ১০০ থেকে ১১০ টাকায়। চিচিঙার দাম তালিকায় ছিল ৮০ টাকা, অথচ বাজারে তা ১২০ টাকা। নতুন শিমের দাম নির্ধারিত ছিল ২২০ থেকে ২৪০ টাকা, কিন্তু বাজারে পাওয়া যাচ্ছে ২৫০ টাকায়। কাঁচামরিচের দাম তালিকায় ১৮০ থেকে ২০০ টাকা থাকলেও বাজারে তা ২০০ টাকার কমে বিক্রি হচ্ছে না। পেঁপের দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল ৩৫ থেকে ৪০ টাকা, অথচ বাজারে পাওয়া যাচ্ছে ৪০ থেকে ৫০ টাকায়। আলুর নির্ধারিত দাম ২৫ টাকা হলেও বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৩০ টাকায়।

মাছের বাজারেও বেশ চড়াভাব দেখা গেছে। বিক্রেতারা জানিয়েছেন, বর্তমানে চাষের মাছের সরবরাহ কিছুটা কম। এতে নদীর কিছু মাছের দাম বেড়েছে। বাজারে ইলিশসহ চিংড়ি মাছের দাম চড়া। প্রতি ৭০০ গ্রামের একহালি ইলিশ ৪ হাজার টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে। এছাড়া এক কেজির বেশি ওজনের ইলিশ প্রতি পিস দুই থেকে তিন হাজার টাকা দাম হাঁকছেন বিক্রেতারা। ৪০০-৫০০ গ্রামের মাছ প্রতি কেজি ৮০০ টাকা বিক্রি হচ্ছে।

অন্যদিকে দাম বেড়ে প্রতি কেজি চাষের চিংড়ি ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকা এবং নদীর চিংড়ি ১০০০ থেকে এক হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে। স্বাভাবিক সময়ে এর দাম কেজিতে ৫০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত কম থাকে।

এছাড়া কই, শিং, শোল, ট্যাংরা ও পুঁটির দাম বাড়তি। চাষের রুই, তেলাপিয়া ও পাঙ্গাশও আগের চেয়ে ২০ থেকে ৫০ টাকা বেড়েছে। প্রতি কেজি চাষের রুই, কাতলা ৩৫০-৪২০ টাকা, তেলাপিয়া ২২০-২৬০ টাকা ও পাঙ্গাশ ২০০-২৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি বিক্রি ১৭০ থেকে ১৮০ এবং সোনালি জাতের মুরগি ৩০০ থেকে ৩২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। প্রতি ডজন ফার্মের ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকা দামে।

এমন পরিস্থিতিতে ক্রেতারা দিশাহারা হয়ে পড়েছে। বাজার করতে আসা মহাখালী কাঁচাবাজারের ক্রেতা হেলাল উদ্দিন বলেন, সরকারের কোনো নজরদারি নেই বলেই বাজারে তালমাটাল অবস্থা চলছে। মাছ-মাংস কিনতে গেলে কয়েক হাজার টাকা নিয়ে যেতে হয়। এখন ছোট মাছের দামও নাগালের বাইরে। সীমিত আয়ের মানুষ প্রতি মাসে ঋণ না করলে সংসার চালাতে পারছে না।

রাজধানীর মিরপুরের এক গৃহিণী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, প্রতিদিন বাজারে এসে দেখি সব কিছুর দাম বেড়ে গেছে। সরকার নির্ধারিত দামের তালিকা দেখি টিভি আর পত্রিকায়, কিন্তু বাজারে এসে সেই দামে কিছু পাওয়া যায় না। শুধু সবজি কিনলেই হাজার টাকার নোট ভাঙাতে হয়।

এদিকে খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, তারা সরকারের নির্ধারিত দামে পণ্য কিনতে পারেন না। বরং পাইকারি বাজারে বেশি দামে কিনে আনতে হয়, যার ওপর পরিবহন খরচ, মজুদ সমস্যা, মৌসুমি প্রভাব এবং সরবরাহ ঘাটতি যুক্ত হয়ে দামে আরও অস্থিরতা তৈরি করে।

মিরপুর কাঁচা বাজারের বিক্রেতা জালাল উদ্দিন বলেন, সরকার যে দাম নির্ধারণ করে, সেই দামে তো মাল পাই না। আমাদেরও তো লাভ করতে হবে। আমরা পাইকারি বাজার থেকে যত দামে কিনে আনি, তার থেকে কম দামে তো বিক্রি করতে পারি না। 

আরেক বিক্রেতা মানিক হোসেন জানান, বর্ষায় উৎপাদন কমে, পরিবহন খরচ বেড়ে যায়। সব মিলিয়ে দামের ওপর চাপ পড়ে।

অর্থনীতিবিদদের মতে, বাজারে স্থিতিশীলতা আনতে হলে শুধু দাম নির্ধারণ করলেই চলবে না, দরকার বাস্তবায়ন এবং নজরদারি।

বাজার বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শুধু প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা সরবরাহ ঘাটতি নয়, বাজারে ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট ও তদারকির অভাবও দায়ী। বাজার তদারকি না থাকায় অসাধু ব্যবসায়ীরা অযৌক্তিকভাবে দাম বাড়িয়ে ভোক্তাদের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে।